২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা হ্রাসের পরিকল্পনা সরকারের
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায়, আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়ন ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা প্রক্ষেপণে আরও সংরক্ষণমূলক হবে সরকার। অর্থাৎ, বাজেটের উচ্চাকাঙ্ক্ষী সম্প্রসারণের চেয়ে প্রাধান্য পাবে রাজস্ব নীতির বিচক্ষণতা।
বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটি এবং আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ, এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ধরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে প্রাথমিকভাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫ শতাংশ ধরা হলেও, সংশোধিত বাজেটে এটি কমিয়ে ৬.৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সভায় উপস্থিত সূত্রগুলো জানায়, আর্থিকখাতের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারক এ কমিটির সভায়– স্থানীয় ও বৈশ্বিক নানান কারণে দেখা দেওয়া অর্থনৈতিক সংকটের গভীরতা স্পষ্টভাবে উঠে আসে।
গত এক দশকের মধ্যে (কোভিডকালীন সময় ছাড়া) ধারাবাহিকভাবে বাজেটের আকার বাড়িয়ে উচ্চাভিলাসী বাজেট প্রণয়ন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাজেটের আকার কমাতেই হবে। এর বেশকিছু কারণ উল্লেখ করেন তাঁরা। যেমন: রাজস্ব আদায়ে স্থবিরতা; বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার সীমিত সক্ষমতা; স্থানীয় ঋণে সরকারের সুদব্যয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সীমিত সুযোগ। ফলে সরকারি ব্যয় কমানো আর এড়িয়ে যাওয়ার যেত না।
এদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও দ্রুত কমছে, নভেম্বরের শেষ নাগাদ যা ছিল প্রায় ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার।
যদিও অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা অর্থবছর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলার বাড়ার অনুমান করছেন। আগামী ১৩ ডিসেম্বর আইএমএফ এর ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার পাশাপাশি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে বাজেট সহায়তা বাবদ ঋণ পাওয়া যাবে বলে জানান তাঁরা।
বাজেটের আকার
গত এক দশকের মধ্যে এবারই প্রথম চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকারের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার মাত্র ৫.৬৭ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোভিডকালীন সময় ছাড়া প্রতিবছরই মূল বাজেটের আকার আগের অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ১০ শতাংশের বেশি হারে বাড়ানোর ঐতিহাসিক প্রবণতা থেকে সরে আসার যা ব্যতিক্রমী এক সিদ্ধান্ত।
কোভিডকালীন সময়ে, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকারের প্রবৃদ্ধি হার ছিল সর্বনিম্ন ৬.২৮ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক মহামারি পূর্ববর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে পরের দুই অর্থবছর বাজেটের আকার ১২ শতাংশের বেশি হারে বাড়ানো হয়।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক সংকট বিবেচনায় আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৮ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রাক্কলন করা হয়েছে। একইসঙ্গে চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার কমিয়ে সংশোধিত বাজেটে ৭ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা মূল বাজেটের চেয়ে প্রায় ৭ শতাংশ কম।
২০২৩-২৪ সালের সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা, যা মূল বাজেটের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব নীতিতে কৃচ্ছ্রতা সাধনের নানান উদ্যোগ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমুলক মুদ্রানীতির কারণে– মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সংশোধিত বাজেটে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে আগামী অর্থবছর মূল্যস্ফীতির প্রক্ষেপণ কিছু আশাবাদী মাত্রায় বা ৬.৫ শতাংশ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করছেন, চলতি ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে, যা আগামী বছরের জুন মাসে দাঁড়াবে ৬ শতাংশে। এর মধ্য দিয়ে চলতি অর্থবছরের ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ৭.৫ শতাংশে নেমে আসবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী।
আগামী অর্থবছর মূল্যস্ফীতির হার এবারের সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কমানোর আশা করলেও নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎখাতে কোন ভর্তুকি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থবিভাগ। এতে বিভিন্ন শিল্পের পণ্য উৎপাদন ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহতি রাখা হবে। একইসঙ্গে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬.৭৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। এটি অর্জন হলে, জিডিপির আকার দাঁড়াবে ৫৫ লাখ ২৮ হাজার ৬৫ কোটি টাকায়।
সরকারের উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয়ে কৃচ্ছ্রতা, আমদানি রপ্তানি কমে যাওয়া এবং উচ্চ মূল্যষ্ফীতির কারণে ব্যক্তি সঞ্চয় কমে যাওয়াসহ রাজনৈতিক অস্থিরতায় সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের গতি কমে যাওয়া এবং বৈদেশিক অংশে– সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের নেতিবাচক গ্রোথের কারণে চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধি কমে যাবে বলে মনে করছে অর্থ বিভাগ। আগামী অর্থবছরও এসব প্রতিকূলতা থাকতে পারে বলে জানান অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
অর্থ বিভাগের এই প্রক্ষেপণ দীর্ঘদিন ধরে করা সরকারের অন্যান্য পরিকল্পনাগুলোকে ওলটপালট করে দেবে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা- ২০৪১ (পারসপেক্টিভ প্ল্যান) এ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের বেশি হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
অষ্টম পঞ্চবিার্ষিকী পরিকল্পনায়, আগামী অর্থবছর ৮.৫১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ আইএমএফ এর পূর্বাভাসের তুলনায়ও কম। ঋণদাতা সংস্থাটির হিসাবে, আগামী অর্থবছর ৭.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বাংলাদেশের। যদিও আইএমএফ এই পূর্বাভাস দিয়েছিল ১১ মাস আগে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধির যে বাজেট কৌশল সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল, অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেখান থেকে সরে আসতে হচ্ছে। এখন সরকার অবকাঠামোতে খরচ কিছুটা কমিয়ে মানব সম্পদ উন্নয়নে গুরুত্ব দেবে। এ কারণে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমতে পারে। যদিও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগের বাড়তি ব্যয় করার মত প্রকল্প বা সক্ষমতা দুটোরই ঘাটতি রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত নভেম্বর মাসের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণ মূল্যষ্ফীতি হয়েছে ৯.৪৯ শতাংশ।
অর্থ বিভাগ আশা করছে, সরকার মূল্যষ্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে আগামী জুন নাগাদ মূল্যষ্ফীতি আরও কমে আসবে।
অর্থ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ বিষয়ে টিবিএসকে বলেন, মূল্যষ্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ করে ট্রেজারি বন্ড ও বিলের মাধ্যমে বাজার থেকে ঋণ নিচ্ছে। বাজারে অর্থ সরবরাহ সংকোচনে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে, বাজার সরবরাহ ঠিক রাখতে টিসিবি, ওএমএস বাড়ানো হচ্ছে। বাজার মনিটরিং জোরদার করা হবে। বিলাসপণ্য আমদানিতেও বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ কমিয়ে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা এবং বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
এ অর্থবছরের মূল বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা এবং বাজেট ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয় ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কৃচ্ছ্রতা নীতি না থাকলেও– আশানুরূপ রাজস্ব সংগ্রহ না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে ব্যয় করা হচ্ছে না। উন্নয়ন খাতে সরকার যে থোক বরাদ্দ রেখেছিল সেখান থেকে ব্যয় স্থগিত করা হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছর ঘোষিত কৃচ্ছ্রতা নীতির বাস্তবায়নের সঙ্গে নির্বাচনের কারণে উন্নয়ন ও পরিচালনখাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। গত অর্থবছর কৃচ্ছ্রতা নীতির ফলে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমেছিল।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ টিবিএসকে বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড গতিশীল করতে এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে জরুরি। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছে, ঋণের সুদহারের সীমা তুলে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগের সঙ্গে সংকোচনমূলক রাজস্ব নীতি নেওয়া জরুরি ছিল। এতে প্রবৃদ্ধি যদি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আরও কমেও যায়, সেটাও গ্রহণযোগ্য হবে।
বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রতিকূলতাগুলো আগামী বছরও কাটবে না উল্লেখ করে তিনি বিচক্ষণ রাজস্ব নীতির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সাবেক এই অর্থসচিব বলেন, বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। ফলে বাজেটের আকার আগের মতো বাড়ানো সম্ভব হবে না। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর বাজেটের আকার আবারো বাড়ানো যাবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার যেটা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রাজস্ব আদায়ে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তিনি বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে খুব বেশি ঋণ করা ঠিক হবে না। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের চাহিদা বিবেচনা করতে হবে। সরকারের বেশি ঋণ নেওয়ার কারণে ইতোমধ্যে ট্রেজারি বিলের সুদহার ১১ শতাংশ হয়ে গেছে। এটি আরও বাড়তে পারে। তবে এই সুদহার কোনোভাবেই ১৮ বা ১৯ শতাংশ হওয়া ঠিক হবে না।'