অস্ট্রেলিয়ার সহায়তায় উলের পোশাক রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারে নেওয়ার সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ উল উৎপাদনকারী দেশ অস্ট্রেলিয়া উল প্রক্রিয়াকরণের জন্য বাংলাদেশকে চীনের সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে ভাবছে। তার সুবাদে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে উচ্চমূল্যের উলের পোশাকের বার্ষিক রপ্তানি দশগুণ বাড়িয়ে ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে বাংলাদেশ।
উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশ বর্তমানে উলের উচ্চমূল্যের কিছু স্যুট, শার্ট, প্যান্ট ও নিটওয়্যারের সোয়েটার তৈরি করে রপ্তানির জন্য, যার কাঁচামাল আসে চীন, ইতালি কিংবা ইংল্যান্ড থেকে।
কিন্তু কাঁচামাল—উলের ইয়ার্ন কিংবা ফ্যাব্রিক—বাংলাদেশে তৈরি না হওয়ায় এ থেকে তৈরি পোশাকের বাজার ধরার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তেমন অগ্রগতি নেই। অথচ বিশ্বব্যাপী কেবল উলের ফাইবারের বাজার প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে মূল অংশ দখল করে আছে অস্ট্রেলিয়া ও চীন।
উদ্যোক্তারা বলছেন, এদেশে উল প্রসেসিং ইউনিট হলে স্থানীয়ভাবেই ইয়ার্ন ও ফ্যাব্রিক তৈরি হবে। ফলে লিড টাইমে (ক্রেতাদের কার্যাদেশ থেকে শুরু করে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সময়) প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। এই ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা এখন অনেক পিছিয়ে, যার জন্য ক্রেতারা এ ধরনের পোশাকের অর্ডার দেওয়ার ক্ষেত্রে আস্থা পাচ্ছে না।
বানিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ান উলের প্রসেসিং ইউনিটের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে দেশটির উল-প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের শীর্ষ জাতীয় সংস্থা উল প্রডিউসারস অস্ট্রেলিয়া-র সিইও জো হল-এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করেছে।
সফরকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনসহ (বিটিএমএ) পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, অস্ট্রেলিয়ান প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে উল প্রক্রিয়াজাতকরণের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে সব ধরনের সহযোগিতা ও সমর্থন প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করেন। উল প্রক্রিয়াকরণের উৎপাদন সম্প্রসারণের জন্য তারা পারস্পরিক নেটওয়ার্কিংয়ের প্রস্তাব দেন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বিটিএমএর সহসভাপতি সালেউদ জামান খান। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া এককভাবে সবচেয়ে বেশি উল উৎপাদনকারী দেশ। কিন্তু তাদের এই উলের ৮০ শতাংশই প্রসেস হয় চীনে। ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের অংশ হিসেবে তারা চীনের ওপর এই নির্ভরতা কমাতে চায়, এবং বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশকে ভাবছে। ফলে আমাদের সামনে ভালো একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'একসময় আমরা কেবল কটনের ইয়ার্ন তৈরি করতাম যার দাম ছিল প্রতি পাউন্ড দেড় ডলারের মতো। এর চেয়ে বেশি আমরা চিন্তা করতে পারতাম না। এরপর গত ১৫ বছরে লিনেনের ইয়ার্ন তৈরি হচ্ছে, যার দাম প্রতি পাউন্ড ৯ ডলার। এতে আমরা অনেকদূর এগিয়েছি।
'এখন আমরা তৃতীয় ধাপের চিন্তা করছি, উলের ইয়ার্ন তৈরি করার জন্য। যার মধ্যে প্রিমিয়াম কোয়ালিটির ক্যাশমেয়ার উলের দাম হবে প্রতি পাউন্ড ৭৬ ডলার। আর প্রতি পাউন্ড সাধারণ মানের বা মেরিনো উলের দাম হবে প্রায় ১৩ ডলার।'
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ধরনের উলের প্রক্রিয়াকরণের জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ লাগবে না। বর্তমান স্পিনিং মিলগুলোর সেটআপে কিছু নতুন যন্ত্র ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা যুক্ত করে শুরু করা যাবে।
বাংলাদেশে এ ধরনের উলের পোশাক রপ্তানিকারক কারখানার সংখ্যা খুব বেশি নয়। এ তালিকায় রয়েছে ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপ এবং এনার্জিপ্যাক ফ্যাশনস লিমিটেড।
এনার্জিপ্যাক ফ্যাশনস লিমিটেড বর্তমানে বছরে প্রায় ১৫ হাজারের বেশি স্যুট তৈরি করে, যার একটি অংশ উলের ফ্যাব্রিকসহ মিশ্র ইয়ার্নের ফ্যাব্রিকে তৈরি হয়। এসব স্যুটের একেকটির দাম খুচরা পর্যায়ে প্রায় ৪০০ ডলার।
এনার্জিপ্যাক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, 'বর্তমানে একটি অর্ডার পাওয়ার পর কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খুলে ফ্যাব্রিক আমদানি করতে গিয়ে ৪৫ দিনের মতো সময় লেগে যায়। এ কারণে আমরা প্রতিযোগীদের চেয়ে লিড টাইমে পিছিয়ে যাই। কিন্তু স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল আমদানির সুযোগ থাকলে ক্রেতার কমফোর্ট জোনে থাকত এবং তার আস্থা থাকত।'
তিনি আরও বলে, 'স্থানীয়ভাবে উলের ইয়ার্ন ও ফ্যাব্রিক তৈরি হলে এক্ষেত্রে আমরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় এগিয়ে যাব এবং রপ্তানি অনেক বাড়বে। বর্তমানে বছরে সব মিলিয়ে উলের পোশাক রপ্তানি ১০০ মিলিয়ন ডলারের মতো, যা আগামী পাঁচ বছরে ১ বিলিয়ন ডলার করা সম্ভব হবে।'
সালেউদ জামান খান জিতু মনে করেন, যে সুযোগটি আসতে যাচ্ছে, তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে বার্ষিক ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির জন্য ৫ বছর সময়ও লাগবে না।
বিটিএমএ সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী উলের ফাইবারের বাজারের আকার ৩০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। অবশ্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাইট ঘেঁটে কিছু গবেষণায় এর বাজারের আকার ১৭ বিলিয়ন ডলার বলে জানা গেছে। আর চক্রবৃদ্ধি বার্ষিক প্রবৃদ্ধির (সিএসজিআর) ৫.৫ শতাংশ হিসেবে ২০৩০ সাল নাগাদ তা ২৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে।
বড় চ্যালেঞ্জ আমদানিতে শুল্ক
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে কটন বা কটনের তৈরি ইয়ার্ন বা ফেব্রিক ছাড়া অন্যান্য ফাইবার বা এ-জাতীয় কাঁচামাল অমাদানির ক্ষেত্রে বড় ধরণের ইমপোর্ট ট্যাক্স রয়েছে, যা এ খাতের অগ্রগতির জন্য বড় বাধা।
বর্তমানে উলের ফাইবার আমদানিতে ইমপোর্ট ট্যাক্স প্রায় ৩৮ শতাংশ। এত বেশি কর দিয়ে এই কাঁচামাল আমদানি করে রপ্তানি করতে গেলে তাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা তৈরির সুযোগ কম। ফলে কটনের মতো এই কাঁচামাল আমদানিতেও কর রেয়াত দিলে রপ্তানিকারকদের জন্য তা সহায়ক হবে।
বিটিএমএর নেতারা বলছেন, তারা গত কয়েক বছর ধরে এ ধরনের ফাইবার, ইয়ার্ন বা ফ্যাব্রিক আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক মওকুফের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দাবি জানিয়ে এলেও তাতে ফল মিলছে না।
গত ২৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ান প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায়ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছেন তারা।
সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুর রহিম খান এসব সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।