বছরের পর বছর নিয়ম ভেঙে সরকারি তহবিল থেকে পেনশন দিচ্ছে কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান
অর্থ বিভাগের অনুমোদন ছাড়াই বছরের পর বছর সরকারি তহবিল থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন এবং অবসর সুবিধা দিয়ে আসা ১২টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের পেনশন তহবিল আটকে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর ইত্যাদি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনগণের অর্থ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের অনিয়মের ইঙ্গিত এটি।
কেবল তা-ই নয়। সরকারি অর্থের অপব্যবহার করা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত এ প্রতিষ্ঠানগুলোর পেনশন স্কিমের অনিয়মের শিকড় আরও গভীর।
একই ক্যাটাগরির আরও ১৩টি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয়ের অর্থে পেনশন সুবিধা চালুর শর্ত থাকলেও এগুলো পেনশন-অবসর সুবিধা দিতে সরকারি তহবিল ব্যবহার করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পেনশন স্কিমের তহবিল আংশিকভাবে স্থগিত করা হয়েছে এবং নিজস্ব আয় ব্যবহার করে এগুলোকে এ ধরনের সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কেবল গত অর্থবছরেই এসব প্রতিষ্ঠানের পেনশন ও অবসরকালীন সুবিধা বাবদ সরকারি তহবিল থেকে এক হাজার ১০১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ৬৮৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকাসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর পেনশন তহবিলের জন্য মোট ৭৭৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল।
তবে অর্থ বিভাগ এসব প্রতিষ্ঠানের পেনশন স্কিমের জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে কোনো তহবিল বরাদ্দ করেনি। মন্ত্রণালয় এ ১২টি প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত কর্মচারীদের পেনশন সুবিধার পরিবর্তে গ্র্যাচুইটি সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
কর্মকর্তারা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে এই ২৫টি প্রতিষ্ঠান বেআইনিভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অগোচরে পেনশন খাতে পরিচালন বাজেটের তহবিল ব্যয় করেছে। তবে গত অর্থবছরের শেষে এ বিষয়গুলো নজরে আসার পর মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবার কঠোর হয়েছে।
১৯৯৯ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা নির্দেশনা অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ বিভাগের অনুমতি নিয়ে তাদের নিজস্ব আয় দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পেনশন সুবিধা চালু করতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মাহবুব আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অর্থ বিভাগের এই বিষয়টি আরও আগেই, অডিট রিপোর্টের সময় চিহ্নিত করা উচিত ছিল।
তিনি বলেন, এ প্রতিষ্ঠানগুলো যদি বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের সময় তাদের বাজেট বরাদ্দ ও ব্যয় যাচাই-বাছাই করত, তাহলে এ ধরনের অসঙ্গতি এড়ানো যেত। 'এটি অর্থ বিভাগের তত্ত্বাবধানে একটি দুর্বলতা।'
মাহবুব আহমেদ বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো নিঃসন্দেহে আর্থিক বিধান লঙ্ঘন করেছে এবং অর্থ বিভাগের উচিত এ ধরনের অনিয়ম রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
সাবেক এ সচিব আরও বলেন, রাজনৈতিক চাপসহ নানা কারণে বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং।
এদিকে সরকারের আরও ১৪টি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মচারীদের জন্য পেনশন স্কিম চালুর প্রস্তাব পাঠিয়েছিল অর্থ বিভাগে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম হওয়ায় তা অনুমোদন করেনি মন্ত্রণালয়।
তবে অর্থ বিভাগের সম্মতিসাপেক্ষে নিজস্ব অর্থে পরিচালিত ১৭টি প্রতিষ্ঠানের পেনশন স্কিম চলমান থাকবে।
পেনশন স্কিমের তহবিলে অনিয়ম
অনুমোদন ছাড়াই গত অর্থবছরে পেনশন স্কিমের জন্য বরাদ্দ করা সরকারি তহবিলের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই ব্যয় হয়েছে ৬৮৯ কোটি টাকা।
এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, শিল্পকলা একাডেমি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
নিজস্ব আয়ে পেনশন প্রকল্প পরিচালনার জন্য অনুমোদিত, কিন্তু সরকারি তহবিল থেকে পেনশন পরিচালনা করছে এমন ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড ইত্যাদি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড গত অর্থবছরে পেনশন ও অবসরকালীন সুবিধা প্রদানে সরকারি তহবিল থেকে সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ২০০০ সালে নিজস্ব অর্থে পেনশন স্কিম চালু করার অনুমোদন পায় এটি।
একইভাবে ২০১৪ সালে বিআইডব্লিউটিএ নিজস্ব তহবিল দিয়ে পেনশন স্কিম চালুর অনুমোদন লাভ করে। গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০ কোটি টাকা।
নিজস্ব অর্থে পেনশন স্কিম চালুর জন্য অর্থ বিভাগ থেকে অনুমোদন নেওয়া বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক) ও বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনও সরকারি তহবিল থেকে গত অর্থবছর পেনশনে প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, পেনশন স্কিমে সম্মতি দেওয়ার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ। যেসব প্রতিষ্ঠান পেনশন তহবিলের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে সরকার থেকে নিয়মিত বার্ষিক অনুদান পাওয়ার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য পেনশন স্কিম প্রবর্তনে সম্মতি দেওয়া হলে ভবিষ্যতে আর্থিক দায়ভার সরকারের ওপরই বর্তাবে।
অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, যেসব স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান সরকার থেকে ঋণ বা ইক্যুইটি নিয়েছে এবং সেসব ঋণ ফেরত দিতে পারছে না বা সরকারকে প্রাপ্য ডিভিডেন্ট দিতে পারছে না, সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য পেনশন স্কিম চালু করা সমীচীন নয়।
পর্যাপ্ত আয় নেই, তবু পেনশন চায় ১৪ প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)-এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পেনশন ও অবসরকালীন সুবিধা বাস্তবায়নের অনুমোদনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে অর্থ বিভাগ।
সূত্রমতে, প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের জন্য পেনশন সুবিধা চালু করতে হলে বর্তমান বেতনস্কেলের ভিত্তিতে পরবর্তী ২০ বছরে ৮৩৭ কোটি টাকা প্রয়োজন, যেখানে তাদের জন্য বিদ্যমান গ্র্যাচুইটি স্কিমের ব্যয়ের পরিমাণ একই সময়ে হবে ২৫০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিসিকের বার্ষিক আয় ৩৫ কোটি টাকা এবং ব্যয় ২২৯ কোটি টাকা। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি সরকারী তহবিলের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল এবং গত অর্থবছরে ১৮৯ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে, তাই পেনশন প্রকল্প চালু করা হলে প্রতিষ্ঠানটির সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত পেনশন প্রকল্পের অনুমোদন স্থগিত করেছে অর্থ বিভাগ। বিভাগ স্থলবন্দর বর্তৃপক্ষের আর্থিক সক্ষমতা থাকার কথা উল্লেখ করলেও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের শর্ত প্রতিপালন করেনি।
এছাড়া ২৪টি স্থলবন্দরের মধ্যে ৭টি বন্দর স্ব-তত্ত্বাবধানে এবং ৬টি বেসরকারি অপারেটরের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। কর্তৃপক্ষ যদি ভবিষ্যতে ২৪টি স্থলবন্দরের তত্ত্বাবধান করে, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির জনবল ব্যবস্থাপনা ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্থ বিভাগ একইভাবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের পেনশন চালুর প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে।
পেনশন স্কিম চালুর প্রস্তাব অনুমোদিত না হওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আরও রয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা, বাংলাদেশ বোর্ড অভ ইউনানী অ্যান্ড আয়ুবেদিক সিস্টেমস অভ মেডিসিন, বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ইত্যাদি।