পেনশন স্কিমে আগ্রহ কম, সঞ্চয়কারীরা অন্য বিকল্প বেশি পছন্দ করছেন
ব্যাংকের চেয়ে তুলনামুলক কম সুদ, মেয়াদ শেষে এককালীন কোনো অর্থ না পাওয়ার বিধান এবং ডলারের তুলনায় টাকার উচ্চহারে অবমূল্যায়নের কারণে প্রবাসীসহ বাংলাদেশিদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করতে পারছে না সর্বজনীন পেনশন স্কিম।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, গত ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর প্রথম এক মাসে ৩৯৮ জন প্রবাসী এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে চাঁদা পরিশোধ করেন। কিন্তু এ হারও পরে বজায় থাকেনি, ফলে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরের তিন মাসে এই স্কিমে যুক্ত হয়েছেন মাত্র ৯১ জন প্রবাসী।
চালুর পরে বিপুল পরিমাণ প্রবাসী এই পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত হয়ে বৈধ চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাবেন বলে আশা করেছিলেন পেনশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু, সে প্রত্যাশা পূরণ এখনও হওয়া বাকি। এই অবস্থায়, পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পরে স্কিমগুলোতে স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও প্রবাসীদের আগ্রহ বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এসব পদক্ষেপের মধ্যে থাকতে পারে– সুদহার পর্যালোচনা, ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সুফল সম্পর্কে প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা, এবং দেশের করপোরেট হাউজগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে উৎসাহিত করার উদ্যোগ।
গত ১৭ আগস্ট চালু করা সর্বজনীন পেনশনে সরকার চারটি স্কিম রেখেছে, এগুলো হলো– প্রবাসীদের জন্য 'প্রবাস', বেসরকারিখাতের চাকরিজীবীদের জন্য 'প্রগতি', অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের জন্য 'সুরক্ষা', এবং অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের জন্য 'সমতা'।
এই চারটি স্কিমে প্রথম মাসে ১২ হাজার ৯৭০ জন অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। পরের তিন মাসে এটি বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ১৬৬ জনে। ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পেনশনের স্কিমগুলোয় চাঁদা জমা পড়েছে প্রায় ২১ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
ব্যাংকের চেয়ে পেনশন স্কিমের সুদহার কম
আগ্রহ কমার ব্যাখ্যা দিয়ে অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তদের জন্য প্রায় ৮ শতাংশ হারে সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে। বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক বর্তমানে মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে। তাছাড়া, অন্যান্য সেভিংস ইন্সট্রুমেন্টে বিনিয়োগ করলে উচ্চ সুদহারের পাশাপাশি মূল আমানতের অর্থও ফেরত পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
একজন ব্যক্তি ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত মাসিক কিস্তি জমা দেওয়ার পরে মাসিক পেনশন পাওয়া শুরু করবে। বেসরকারিখাত ও অনানুষ্ঠানিকখাতের কর্মীদের এতো দীর্ঘ সময় ধরে কিস্তি দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত আয় থাকবে কি-না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
এবিষয়ে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, "সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় স্কিমগুলোতে যে সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটিও ফ্লেক্সিবল (পরিবর্তনযোগ্য)। কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সময় সময় এটি পুনঃনির্ধারণ করবে। নির্বাচনের পরে এক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে"- বলে জানান তিনি।
এছাড়া, মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা কোম্পানি 'নগদ' এর সঙ্গেও চুক্তি স্বাক্ষর করেছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। এর ফলে মোবাইলের মাধ্যমেও গ্রাহকরা সহজে সর্বজনীন পেনশনের চাঁদা জমা দিতে পারবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. সায়মা হক বিদিশা টিবিএসকে বলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিমগুলোকে আর্থিকভাবে আকর্ষণীয় হতে হবে। "প্রবাসীদের আগ্রহী করতে হলে, তাঁদের বুঝাতে হবে, অন্যান্য বিনিয়োগের চেয়ে সর্বজনীন পেনশনে বিনিয়োগ করলে বেশি লাভ হবে। স্কিমটাও সেভাবে সাজাতে হবে।"
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, অন্যান্য দেশ স্কিম প্রণয়নে কি কি মডেল অনুসরণ করছে, সেগুলো পর্যালোচনা করেও আমাদের স্কিমগুলো রিভাইজ করা যেতে পারে।
প্রবাসীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে গত ১৫ নভেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে একটি সভা করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সভায় অর্থ সচিব ড. মো. খায়রুজ্জামান বলেছেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে রেজিস্ট্রেশনের গতি 'অত্যন্ত মন্থর'। বিশেষত, 'প্রবাস' স্কিম এর সাবস্ক্রিপশন একেবারেই সীমিত।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান সভায় বলেছেন, স্কিমগুলোতে যতোবেশি জনগণ অন্তর্ভূক্ত হবে, সর্বজনীন পেনশনের উদ্দেশ্য ততোবেশি ফলপ্রসূ হবে। প্রবাসীদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে নিবন্ধন সহজ করাসহ তাঁরা যাতে সহজে চাঁদা পরিশোধ করতে পারেন, সেজন্য অনলাইন ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করার পরামর্শ দেন তিনি।
রেমিট্যান্স আনাসহ প্রবাসীদের পেনশন স্কিমে চাঁদা সংগ্রহ বাড়াতে বিদেশে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব আইটি অবকাঠামো দ্রুত উন্নত করতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
পেনশন স্কিমগুলোর ক্ষেত্রে সকল বাধা কার্যকরভাবে অপসারণ করতে বিদেশে তাদের নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম, এক্সচেঞ্জ হাউজ, ফিনটেক কোম্পানির সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে ব্যাংকগুলোকে।
এছাড়া, ব্যাংকগুলোকে দেশে ও বিদেশে নিজস্ব উদ্যোগে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সুফল সম্পর্কে প্রয়োজনীয় প্রচার কার্যক্রম চালাতে অনুরোধ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা
ওই সভায় প্রবাসীদের সর্বজনীন পেনশনে আকৃষ্ট করার পাশাপাশি করপোরেট হাউজগুলোকে সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর সহযোগিতা চেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
দেশের করপোরেট হাউজগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সাধারণত ব্যাংকের মাধ্যমেই পরিশোধ করা হয়ে থাকে। ব্যাংকগুলো যেসব করপোরেট হাউজের পে-রোল সেবা দিয়ে থাকে, সেসব কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার 'প্রগতি' স্কিমে অন্তর্ভূক্তির জন্য প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চালাতে ব্যাংকের সিইওদের অনুরোধ করেছে অর্থ বিভাগ।
ব্যাংকারদের প্রতিশ্রুতি
সভায় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আফজাল করিম জানান, তাঁর ব্যাংকের নিজস্ব পেমেন্ট গেটওয়ে এবং ই-ওয়ালেট রয়েছে, বিমা সাবস্ক্রাইবার আকৃষ্ট করতে যা কাজে লাগানো হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে সোনালী ব্যাংকের এজেন্ট আছে, তাদের কাজে লাগিয়ে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো ও সর্বজনীন পেনশনের 'প্রবাস' স্কিমে অন্তর্ভূক্তির জন্য সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়াতে তারা ভূমিকা রাখবেন।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন সব ব্যাংকের শাখাগুলোকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, এসব শাখায় হিসাব খোলার সময় ব্যাংকের গ্রাহকদের সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মজিবুর রহমান জানান, বিদেশগামীদের তার ব্যাংক তিন দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। "প্রশিক্ষণকালীন সময়ে তাঁদেরকে 'প্রবাস' স্কিমে যুক্ত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হবে। তাছাড়া, যেসব কর্মী এ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে, তাদের ঋণ দেওয়ার সময় প্রবাস স্কিমে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করে রাখা যেতে পারে"- বলে প্রস্তাব দেন তিনি।