ব্যবসায়ীরা চান হয়রানির অবসান, আমদানি-রপ্তানিতে প্রকৃত ঘোষণার পক্ষে এনবিআর
বিনিয়োগ বাড়াতে কর কাঠামোকে সরল ও হয়রানিমুক্ত করার মাধ্যমে সহজে ব্যবসা করার পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলেছেন, দেশের কর ব্যবস্থা সহজ করতে হবে। পাশাপাশি কর সংগ্রহ ব্যবস্থাকে হয়রানিমুক্ত করতে হবে। নতুবা নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে।
মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ চেম্বার্স অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) কার্যালয়ে আয়োজিত "বিল্ডিং এ রেজিলিয়েন্ট ইকোনমি ফর ভিশন ২০৪১: কি চ্যালেঞ্জেস এন্ড ওয়ে ফরওয়ার্ড" শীর্ষক কর্মশালায় ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন।
কর্মশালায় উপস্থিত সরকারের নীতিনির্ধারক ও রাজস্ব কর্মকর্তারা যার জবাবে বলেছেন, ব্যবসায়ীরা মিথ্যা ঘোষণা বন্ধ করলে– জরিমানা বা কাস্টমসে পণ্য আটকে থাকার ঘটনা ঘটবে না। আর করনীতি যতোটা সম্ভব সহজ করার বিষয়ে সরকারও কাজ করছে। একইসঙ্গে ব্যবসার পরিবেশ সহজ করা এবং বিনিয়োগ আকর্ষণে বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়ন করছে।
দেশে ব্যবসাবাণিজ্যের দীর্ঘদিনের বিভিন্ন সমস্যা, এবং সেগুলো সহযোগিতামূলকভাবে সমাধানের পথ তৈরির বিষয়ে– এ কর্মশালায় ব্যবসায়ী নেতা ও সরকারের কর্মকর্তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ হয়েছে।
কর্মশালার প্রধান অতিথি ছিলেন বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ড. আহমেদ কায়কাউস। বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (কাস্টমস) মাসুদ সাদিক।
সহজ কর ব্যবস্থা, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ চান ব্যবসায়ীরা
অনুষ্ঠানের শুরুতে বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাণিজ্য খাতকে আরও কার্যকরী করতে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে, রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এজন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি তিনি কর কাঠামো সহজ ও দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেন, যা প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হবে।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম বলেন, কর ব্যবস্থা কোনোভাবেই ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগবান্ধব নয়। আগাম আয়কর (এআইটি) ফেরত বা সমন্বয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে প্রকৃত কর কখনো কখনো ১০০ থেকে ৩০০ শতাংশ হয়ে যায়। আমদানি-রপ্তানিকারকদের বহু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। রেগুলেটরি অথরিটি যদি মনে করে, ব্যবসায়ীরা সব খারাপ– তাহলে এই উন্নয়নের ধারা ঠিক থাকবে না।
"রপ্তানিকারকদের পণ্য কাস্টমসে ১০-১৫ দিন করে আটকে রাখা হয়। এজন্য ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা জরিমানা গুনতে হয়। কাস্টমসের প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি বন্ধের উপক্রম হয়েছে"- বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এইচএসবিসি বাংলাদেশের সিইও মাহবুবুর রহমান বলেন, "আমরা কাঁচামাল আনতে পারছি না বিধায় সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হচ্ছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে, কারণ আমদানি কমে গেছে। আনুষ্ঠানিক বা বৈধ চ্যানেলে ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসছে। বলা হয়, আরও ২৫ বিলিয়ন ডলার ইনফরমাল ওয়েতে আসছে। এতে বাজারে চাহিদা বাড়ছে। এই চাহিদা মেটাতে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।"
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তালহা ইসলাম বারী বলেন, "এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ খাতের উন্নয়নে মনোযোগ দরকার। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে।"
এফবিসিসিআই পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। "স্বাস্থ্য বিমা নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য একটি স্বাধীন আর্থিক নীতি দরকার।"
গবেষণা প্রতিষ্ঠান– পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)- এর চেয়ারম্যান জায়দি সাত্তার বলেন, ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জন করতে চাইলে, আগামী দুই দশক গড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে হবে। একটি বৈচিত্র্যময় ও বহুমুখী বৈদেশিক বাণিজ্য খাতের মাধ্যমে যা অর্জন করা সম্ভব।
ব্যবসার সমর্থনে দরকারি সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি কর্তৃপক্ষের
প্রধান অতিথি ড. আহমেদ কায়কাউস বলেন, ২০৪১ এর লক্ষ্য থেকে দেশ খুব দুরে নেই। "দিজ ইজ দ্য টাইম টু রিগেইন আওয়ার কনফিডেন্স। আশাবাদ নিয়ে এগোতে হবে।"
তিনি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, "আপনারা সম্ভাবনা ও সমস্যা খুঁজে বের করুন। সরকার সেগুলোতে আপনাদের সহযোগিতা করবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও সমাজের উন্নয়নে অংশ নিতে হবে। সেই মানসিকতায় আসুন। শুধু ব্যবসা বা মুনাফা করলে হবে না।" তিনি আরও বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলো ঠিকমত পরিচর্যা করলে– আমরা নিজেরাই নিজেদের পথ তৈরি করতে পারব।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, "ভোজ্য তেল, চিনি ও গমের মতো খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আমদানি-নির্ভর দেশ। সর্বোত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে এসবের উৎপাদন বাড়ানো দরকার।" তিনি বলেন, "বিশ্ববাজারে আমাদের পণ্য প্রতিযোগিতামূলক করা যাচ্ছে না। এখানে আমাদের দূর্বলতা শিক্ষা। অনেক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু ফাউন্ডেশন দূর্বল থাকায় প্রশিক্ষণ নিতে পারছে না। শিক্ষায় ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে– প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে।"
এনবিআরের সদস্য মাসুদ সাদিক বলেন, শুল্ক কর কাঠামো আরও যৌক্তিকীকরণ করতে হবে এটা সত্য। এনবিআর সব পক্ষের মতামত নিয়ে বাজেটের শুল্ক কাঠামো ঠিক করে। তবে যত সুপারিশ/পরামর্শ আসে– সব রাখা যায় না।
তিনি বলেন, "অন্যদিকে এনবিআরের ওপর রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর চাপও আছে। আগামী বছর কাস্টমস থেকে ২০ শতাংশের বেশি রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে। এফটিএ সই করতে– ট্যারিফ রেট কমাতে হবে। কিন্তু, এনবিআর তা ব্যাপকভাবে কমাতে পারে না। তবে ধাপে ধাপে কমিয়ে আনতে চেষ্টা রয়েছে। আগামী দুই বছরে কোনো মিনিমাম ভ্যালু বা ট্যারিফ ভ্যালু থাকবে না। বর্তমানে ১২৮টি পণ্যে মিনিমাম ভ্যালু আছে। আগামীতে এসব তুলে দেওয়া হবে।"
"ব্যবসায়ীরা যদি সঠিক মূল্য ঘোষণা দেয়, তাহলে কিন্তু মিনিমাম ভ্যালু করতে হয় না। জরিমানা এড়াতে সঠিক ডিক্লারেশন দরকার" - যোগ করেন মাসুদ সাদিক।
ব্যবসায়ীদের হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "এনবিআরের কর্মচারীরা সবাই যে ভালো তা নয়। অনেককে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। আশা করা যায়, আগামীতে পরিস্থিতির আরও ভালো হবে। আপনারাও সঠিক ঘোষণা দিবেন।"
মূল প্রবন্ধে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, নির্বাচনের পর নতুন সরকার অর্থনৈতিক নীতি ঢেলে সাজানোর সুযোগ পাবে। বর্তমান প্রেক্ষাপট ও দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা নিয়ে পরিকল্পনা করার সুযোগ রয়েছে। সরকারকে মাথায় রাখতে হবে, সঠিক পলিসিতে বেসরকারি খাতকে বেগবান হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক শাহরিয়ার সিদ্দিক বলেন, "ব্যাংকখাতের সুশাসন নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকের বোর্ড ও ব্যবস্থাপকদের এর রোল (ভূমিকা) নিয়ে কাজ হচ্ছে। কার কি দায়িত্ব, তা আরও পরিস্কার করে দেওয়া হবে। খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনার জন্য অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনের কাজ হচ্ছে।"