অনিশ্চিত ব্যবসার পরিবেশের মধ্যে কমে গেছে নতুন কোম্পানি নিবন্ধন
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তায় বাংলাদেশের ব্যবসার পরিস্থিতিও অনিশ্চয়তায় পড়ে যাওয়ায় ব্যবসা করার জন্য নতুন কোম্পানির নিবন্ধন নেওয়ার পরিমাণ ব্যাপক হারে কমেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালের অধীনস্থ কোম্পানি নিন্ধন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ৪ হাজার ৫১৬টি পাবলিক, প্রাইভেট কোম্পানি, একক ব্যক্তি কোম্পানি (ওপিসি) এবং পার্টনারশিপ ফার্ম নতুনভাবে নিবন্ধিত হয়েছে।
অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রায় ৮ হাজার ৩১৪টি নতুন কোম্পানি নিবন্ধন নিয়েছিল। আর গত অর্থবছরে মোট নিবন্ধন নিয়েছে ১০ হাজার ৫২৩টি কোম্পানি।
এছাড়া নতুন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিনিয়োগের প্রস্তাব আসাও অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কমেছে বলে জানিয়েছে আরজেএসসির একটি সূত্র।
কী কারণে নতুন কোম্পানির নিবন্ধনে ভাটা পড়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা প্রভাব ফেলেতে পারে।
'কারণ বিরোধীরা যেভাবে জ্বালাও-পোড়াও এবং অরাজকতা করেছে, এতে করে ব্যবসায়ীদের মনে এক ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। এর কারণেও অনেক ব্যবসায়ী নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে চায়নি,' বলেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন, 'চলতি অর্থবছরের মাত্র ছয় মাসের হিসাব এটি [৪ হাজার ৫১৬টি নতুন কোম্পানির নিবন্ধন]। এটিকে কম বলা যাবে না। কারণ অর্থবছরের বাকি সময়য়ে অরও অনেক বেশি নতুন কোম্পানি নিবন্ধন পাবে।'
নির্বাচনের পর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বর্জনের মধ্য দিয়ে রবিবার (৭ জানুয়ারি) বাংলাদেশের দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আরজেএসসির তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ হাজার ৫২৩টি, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১৩ হাজার ২১৮টি এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৮২৬টি নতুন কোম্পানি নিবন্ধন নিয়েছে।
আরজেএসসি সূত্র জানিয়েছে, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে নতুন কোম্পানি নিবন্ধন নেওয়ার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৫০টি নতুন কোম্পানি নিবন্ধনের আবেদন প্রক্রিয়া প্রক্রিয়াধীন আছে; যেখানে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার আবেদন প্রক্রিয়াধীন ছিল।
গত অর্থবছর ও চলতি অর্থবছরে নিবন্ধন নেওয়া প্রায় ২০টি কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে অলাপ করে জান গেছে, তারা এক-দেড় বছর আগে কোম্পানির নিবন্ধন নিলেও এখনও পর্যন্ত কোম্পানির কার্যক্রম শুরু করতে পারেননি।
বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিসিআই) সেক্রেটারি জেনারেল মামুন মৃধা টিবিএসকে বলেন, কোভিড মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে যে মন্দার সৃষ্টি হয়েছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা মিলে নতুন কোম্পানি চালুর প্রবণতা অনেকটাই কমছে।
তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে অনেক কোম্পানিই ঠিকমতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না। অনেকে ব্যবসার পরিসর ছোট করছে, কর্মী ছাঁটাই করছে।
মামুন মৃধা আরও বলেন, 'বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা এখন বেশ নাজুক। ফলে নতুন করে কোম্পানি না খুলে অনেক দেশি-বিদেশি কোম্পানি রি-ইনভেস্টমেন্টের দিকে যাচ্ছে। আবার অনেকেই বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগ নিয়ে অপেক্ষা করছে। শিগরিই এই অবস্থা উন্নতি হবে এবং ব্যবসায়ীরা নতুন করে ব্যবসা শুরু করবে।'
তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেরকমই থাকুক না কেন, সব খাত বিশেষ করে ব্যবসায়ী ও ব্যাংক খাতে সুশাসন বাস্তবায়ন করে ব্যবসার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবীদরা।
বিনিয়োগ প্রস্তাব কমে গেছে
নতুন কোম্পানিগুলি ২০২৩-২৪ অরথবচরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। পুরো ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়াও ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪১ হাজার কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব ছিল।
আবার যারা নতুন কোম্পানির নিবন্ধ নিয়েছে, তাদের বেশরিভাগই ব্যবসা শুরু করতে পারেনি।
কোম্পানি নিবন্ধন থেকে রাজস্ব আয় কমে গেছে
আরজেএসসির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ১০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে কোম্পানি নিবন্ধন খাত থেকে। যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ১৯৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছিল এ খাত থেকে।
কোম্পানি নিবন্ধন খাত থেকে পুরো ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ২৭০.৬১ কোটি টাকা, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ২৯৬.৬ কোটি টাকা এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ২১৫ কোটি টাকা আয় হয়েছিল আরজেএসসির।
ভালো ব্যবসার পরিবেশের জন্য সুশাসন আবশ্যক
অর্থনীতিবীদ আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, 'মোদ্দা কথা, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার ও সংশ্লিষ্টরা। [নির্বাচনের পর] এই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। ফলে নতুন করে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।'
তিনি বলেন, শুধু দেশি নয়, বিদেশি বিনিয়োগও কম আসছে। কারণ একদিকে সুশাসনের অভাব, আরেকদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। অনেক উদ্যোক্তা ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করছেন। নির্বাচনের পর দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা কোথায় যাবে, সেটি নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, 'এখন বাংলাদেশের অনেকই বলছে, কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে বৈশ্বিক মন্দা, তার কারণে নতুন বিনিয়োগ কম আসছে। এটি কোনোভাবেই সঠিক নয়। এর মধ্যেও অনেক দেশ ভালো করছে। বাংলাদেশেও সম্ভব। সেটি হবে তখন, যখন সরকারের সদিচ্ছা থাকবে।'
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব-উল আলম বলেন, নির্বাচনের বছর হওয়ায় নতুন ব্যবসা শুরুর পরিমাণ কমছে, ব্যপারটি এরকম নয়। একটি বড় ধরনের বৈশ্বিক সংকটের কারণে এখন ডলার সংকট বেশ বড় আকার ধারণ করেছে।
এর ফলে আমদানি-রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কারণেই নতুন ব্যবসা শুরু কম হতে পারে বলে মত দেন তিনি।
তবে নির্বাচনের পর সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে বলে মনে করেন তানজীব-উল আলম।।
নিবন্ধ নিয়েও ব্যবসা শুরু করছে না কেন
আরজেএসসির একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, চলতি অর্থবছর বছর যে কোম্পানিগুলো অনুমোন নিয়েছে তাদের বেশিরভাগই কার্যক্রম শুরু করেনি।
নতুন নিবন্ধন নেওয়া কয়েকটি কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের এখনও ব্যবসা শুরু না করার কারণ জানার চেষ্টা করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
গাজীপুরের কালিয়কৈর এলাকায় এমআরকে ফুড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি গত বছরের মার্চ মাসে আরজেএসসি থেকে অনুমোদন লাভ করে। তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগের লক্ষ্য ছিল ৬০ কোটি টাকা।
কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসের রহমান টিবিএসকে বলেন, 'এখন ব্যবসার পরিবেশ ভালো নয়। এজন্য অবকাঠামো নির্মাণের কাজ ৪০ শতাংশ সম্পন্ন হলেও বাকিটা সম্পন্ন করতে আগামী ২-৩ মাস পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমাদের কোম্পানি প্রথমিক পর্যায়ে বিস্কুট, ব্রেডসহ শুকনো-জাতীয় খাবার তৈরির পরিকল্পনা করেছে। এরপর পর্যায়ক্রমে রেডিমেড ফ্রোজেন পরোটা, সিঙ্গারা, সমুচাসহ এ জাতীয় খাবার তৈরি করবে।'
তিনি বলেন, 'এসব খাবার উৎপাদনে প্রয়োজনীয় মেশিন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে এখনও এলসি খুলতে পারিনি। এছাড়াও দেশের চলমান রাজনৈতি অস্থিরতার কারণে ফুড সাপ্লাই ও কাঁচামাল সরবরাহে সমস্যা হবে বলে অপাতত সব কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।'
একই কথা বললেন গত বছরের জুন মাসে নিবন্ধন নেওয়া আরেকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান।
রাজশাহীর বোয়ালিয়ার সাবরিন অয়েল ম্যানুফ্যাকচারার লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান রনি বলেন, 'কারখানার অবকাঠামো নির্মাণ শেষ করে তেল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় মেশিন স্থাপন করা হলেও কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।
'এখন ব্যবসা শুরু করলে ক্ষতি হবে। এজন্য নির্বাচন শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছি। পরিবেশ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করা হবে।'
ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
বাংলাদেশ চেম্বার্স অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম টিবিএসকে বলেন, ব্যবসায়ীরা নানাভাবে সংকটপূর্ণ সময় অতিক্রম করছেন। সেটি শুধু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সৃষ্টি হয়নি, হয়েছে বৈশ্বিক সংকটের কারণে।
তিনি বলেন, 'ব্যবসায়ীদের ব্যবসার অবস্থা আরও উন্নত হবে। তবে নতুন ব্যবসা শুরু করতে যেসব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আরজেএসিতে নতুন কোম্পানির অনুমদন নেওয়াও একটি জটিল প্রক্রিয়া।'
এফবিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, 'ব্যবসায়ীরা সবসময় ব্যবসাবান্ধব পরিবশের নিশ্চয়তা চান। এর জন্য আমাদের সংগঠনগুলোও নানা উদ্যোগ নেয়। সরকারও নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন হলে নতুন কোম্পানির পরিমাণ, নতুন ব্যবসার পরিমাণ এবং উদ্যোক্তার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।'
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মহাপরিচালক জীবন কৃষ্ণ সাহা রায় টিবিএসকে বলেন, 'বিডার কাজ হলো ব্যবসার জন্য সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা। কারা বিনিয়োগ করবে আর কারা করবে না, এটি আমাদের দেখার বিষয় না।'