জরুরি চাহিদা মেটাতে আইএফসির কাছে ১৬০ মিলিয়ন ডলার ঋণ চায় স্থানীয় চার ব্যাংক
অফশোর পোর্টফলিও বাড়াতে আবারো বিদেশি তহবিল পাওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এর মাধ্যমে তারা নিজস্ব গ্রাহকদের ডলারে ঋণ দিতে পারবে।
আর্থিক খাতের অভ্যন্তরীণরা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি ঋণের সুদে ২০ শতাংশ কর অব্যাহতির ঘটনা - এধরনের অর্থ ধার নেওয়ার খরচ কমিয়েছে। এতে বৈদেশিক অর্থায়নের দিকে ব্যাংকগুলো নতুন করে আগ্রহী হয়েছে।
স্থানীয় চারটি বেসরকারি ব্যাংক – সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়া – তাদের তাৎক্ষনিক ডলার চাহিদা মেটাতে ও ঋণ দিতে প্রয়োজনীয় ডলার সংগ্রহ করতে – ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি)-র সাথে ১৬০ মিলিয়ন ডলার ধার নেওয়ার আলোচনা করছে।
দেশে ডলার প্রবাহের প্রত্যাশা
দেশের আর্থিক হিসাবের অন্যতম প্রধান অঙ্গ হলো বিদেশ থেকে অর্থ ধার; ডলার প্রবাহ বাড়লে এই হিসাবের ঘাটতি কমার আশা করা হচ্ছে।
আইএফসি তার সদস্য কোনো দেশ বিরোধিতা করলে– সেখানকার কোনো প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অর্থায়ন করে না। তাই এবিষয়ে মতামত চেয়ে সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-কে একটি চিঠিও দিয়েছে।
আইএফসির চিঠিতে বলা হয়েছে, চলতি মূলধনের জোগান এবং স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাণিজ্য-সংক্রান্ত ঋণ প্রদান কর্মসূচিকে সমর্থন দিতে তারা চারটি ব্যাংকে বিনিয়োগের কথা বিবেচনা করছে।
আইএফসির বিনিয়োগ থেকে পাওয়া ডলার দিয়ে ব্যাংকগুলো তাদের তাৎক্ষনিক ডলার তারল্যের চাহিদা মেটাতে পারবে, এবং সেখান থেকে যোগ্য আমদানি/রপ্তানি-ভিত্তিক ঋণগ্রহীতাদের ঋণ দিতে পারবে। এভাবে তারা করোনা মহামারির অভিঘাত ও বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই খাতগুলোকে সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখতে পারবে, চিঠিতে আরও বলা হয়।
কর অব্যাহতি ব্যাংক খাতের জন্য সহায়ক
এবিষয়ে জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা– মাসরুর আরেফিন বলেন, বিদেশি ঋণের সুদের ওপর যে ২০ শতাংশ কর ধার্য করা হয়েছিল, সেটি অব্যাহতি দেওয়ায় ব্যাংকগুলো আবারো বিদেশি উৎস থেকে অর্থ ধার করতে আগ্রহী হয়েছে।
তিনি বলেন, (চলতি অর্থবছরের বাজেটে) ২০ শতাংশ কর ধার্য করার পর আইএফসির ৩০ মিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করে সিটি ব্যাংক। কারণ, বিদেশি ঋণের খরচ বেড়ে যাওয়ায়– গ্রাহকদের ডলারে ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তবে কর অব্যাহতির ফলে অর্থ ধার করার খরচ কমায়– ব্যাংকগুলো আবারো এমন তহবিল সংগ্রহের কথা ভাবতে শুরু করেছে।
তিনি জানান, তহবিল ধার নিতে আইএফসির সাথে মূল্যনির্ধারণ আলোচনা করছে সিটি ব্যাংক, কারণ বিজনেস মার্জিন পেলেই তারা এই তহবিল দেবে। এ ধরনের অর্থ ধার ডলারের তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি করবে, যেখান থেকে আবার আমদানি ও রপ্তানিকারকদের ঋণ দেওয়া যাবে।
মাসরুর আরেফিন বলেন, আর্থিক হিসাবের অন্যতম অঙ্গ হচ্ছে বিদেশি উৎস থেকে অর্থ ধার, তাই এ ধরনের তহবিল দেশে আসলে তা আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কমাতে সহায়তা করবে।
আর্থিক খাতের অভ্যন্তরীণরা জানান, আইএফসির তহবিল পেলে ব্যাংকগুলো স্থানীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে পারবে।
এর আগে চলতি বাজেটে করারোপ করার ফলে বিদেশি মুদ্রায় নেওয়া ঋণের সুদহার বেড়ে ১১ শতাংশ হয়ে যায়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জুলাই থেকে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের ওপর প্রাথমিকভাবে ২০ শতাংশ কর আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর উদ্দেশ্য ছিল, ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান– উভয়ের বৈদেশিক ঋণ নেওয়া কমানো।
ফলে নতুন ঋণ নেওয়ার আগ্রহ হারান ব্যবসায়ীরা, এতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমতে থাকে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এই অবস্থায় তাদের বিদ্যমান ঋণগুলো পরিশোধে বেশি মনোযোগ দেয়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভও তাতে হ্রাস পায় এবং গত এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতোন আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি দেখা দেয়, যা আগে উদ্বৃত্ত ছিল।
২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ১.১ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত থেকে ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক আমানত ও অর্থ ধার নেগেটিভ ৩ বিলিয়ন ডলার হয়ে যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক আমানত অ্যাকাউন্টের এই নেগেটিভ ব্যালেন্স– দেশের আর্থিক হিসাবের ওপর চাপ তৈরি করে; যা ২০২১-২২ অর্থবছরের ১৬.৬ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে নেগেটিভ ২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
ডলার তারল্য কম থাকায় ব্যাংকগুলো তাদের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া সীমিত করলে, আমদানি দায় পরিশোধে দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় বাজার থেকে ডলার কিনতে শুরু করে। এতে ডলারের দরে অস্থিতিশীলতা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
নাম না প্রকাশের শর্তে বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান বলেন, বিদেশি উৎস থেকে ডলার প্রবাহ যখন হ্রাস পায়, তখন রেমিট্যান্সের প্রতি ডলারের আনুষ্ঠানিক দর ১১০ টাকা হলেও– ১২০ টাকা দিয়ে কিনেছে ব্যাংকগুলো। ভবিষ্যৎ দায় মেটানো এড়াতে ব্যাংকগুলো এলসি (ঋণপত্র) খোলাও ব্যাপকভাবে কমায়, এতে দেশের ব্যবসাবাণিজ্যে অচলাবস্থা দেখা দেয়।
ডিসেম্বরে ৩৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন আমদানি
গত কয়েক মাস ধরেই আমদানি কমছে, এরই ধারাবাহিকতায় ডিসেম্বরে আমদানি ৩৭ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম বা ৪.৫৩ বিলিয়ন ডলারের হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে, ডিসেম্বর মাসে বিদেশি ঋণে কর অব্যাহতি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিয়েছে রাজস্ব বোর্ড। তাই ব্যাংকগুলো আবারো বিদেশি অর্থায়ন সংগ্রহে উৎসাহী হয়েছে।
ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক আমানতের হিসাব এখনো নেগেটিভ, তবে তারা বিদেশি উৎস থেকে অর্থ ধার করতে শুরু করায় ধীরে ধীরে এ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ব্যাংকের বৈদেশিক আমানত হিসাবের ব্যালেন্স ছিল নেগেটিভ ৭০০ মিলিয়ন ডলার। জুলাই-অক্টোবর সময়ে যা ছিল প্রায় নেগেটিভ ৯০০ মিলিয়ন ডলার।