বেসিক ব্যাংকের পুঞ্জীভূত সংকট
এক সময়ের বিশ্বস্ত ও লাভজনক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বেসিক ব্যাংক লিমিটেড বর্তমানে গুরুতর আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে। এমনকি ব্যাংকটি পরিচালন ব্যয় মেটাতেও হিমশিম খাচ্ছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর দেখা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংকের কার্যক্রমের বর্তমান মডেলটি টেকসই নয়।
প্রতিবেদনটি চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর কাছে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে ব্যাংকটিকে রক্ষা করার জন্য মন্ত্রণালয়কে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসিক ব্যাংক এর বকেয়া ঋণ পুনরুদ্ধার, নতুন ঋণ বিতরণ এবং কম খরচে আমানত পাওয়ার পদক্ষেপ না নিলে পরিচালন ব্যয় মেটাতে পারবে না।
প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের গড় অনুপাত ৮ দশমিক ২ শতাংশ হলেও ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে ছয়দিন ব্যাংকটির এসএলআর (বিধিবদ্ধ জমা) ঘাটতি ছিল। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘাটতি পরিহারের জন্য তখন ব্যাংকটিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
এসএলআর হলো আমানতের ন্যূনতম শতাংশ যা কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংককে তরল নগদ, সোনা বা অন্যান্য জামানত আকারে বজায় রাখতে হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংকের এসএলআরের প্রায় ৯২ শতাংশ বাংলাদেশ ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে, যা ব্যাংকটির ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে।
ঋণ কার্যক্রমের অনিয়মিত প্রবাহ ও আমানতের স্থবিরতার কারণে ব্যাংকটি এর এসএলআরের সিংহভাগ বাংলাদেশ ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করে রেখেছে। জরুরি নগদ অর্থের প্রয়োজন হলে ব্যাংকটিকে মুদ্রাবাজার থেকে উচ্চ সুদে ধার করতে হতে পারে।
ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাড়ানোর মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকটি এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে বলে প্রতিবেদনে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পতনের কারণ নিয়ে প্রশ্ন
বেসিক ব্যাংকের পতনের শুরু সেই ২০০৯ সাল থেকেই। ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। জাল নথি ব্যবহার করে ঋণ বিতরণের মাধ্যমে এসব আর্থিক কেলেঙ্কারি করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ব্যাংকটি থেকে পদত্যাগ করেন বাচ্চু।
বাচ্চু চেয়ারম্যান হওয়ার আগে ২০০৮ সালে বেসিক ব্যাংকের আর্থিক সঙ্গতি শক্তিশালী ছিল। ওই বছর সুদ থেকে ব্যাংকটির নিট আয় ছিল ১১২ কোটি টাকা। ওই সময়ে ব্যাংকটি কেবল সুদের আয় থেকেই মাত্র ৮১.৭ কোটি টাকার পরিচালন ব্যয় বহন করতে পেরেছিল।
তবে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার মেগা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগের মুখে ২০১৪ সালে বাচ্চুর পদত্যাগের পর ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়। নিট সুদ আয় ১৩৯ কোটি টাকায় নেমে নেতিবাচক ধারায় চলে আসে। একইসঙ্গে পরিচালন ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৭৭ কোটি টাকায়।
কয়েক দফায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন যোগান দেওয়ার পরও বেসিক ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ব্যাংকের ২০২২ সালের বার্ষিক নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকের পরিচালন আয় ১৩১ কোটি টাকার দ্বিগুনে দাঁড়িয়েছে এটির পরিচালন ব্যয়। এছাড়া ২৪৬ কোটি টাকা ঋণাত্মক নিট সুদ আয় এবং সংস্থানপূর্ব ১২৭ কোটি টাকার ঋণাত্মক ক্ষতির কথাও জানা যায়।
২০০৮ সালে বেসিক ব্যাংকের শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ৩৭.৭ টাকা থাকলেও ২০১৪ সালে তা ঋণাত্মক ৩৭ টাকা হয়ে গিয়েছিল। ২০২২ সালেও ব্যাংকটির ইপিএস নেতিবাচক ধারায় ১.২০ টাকা ছিল।
আস্থা হারানোর মাঝেই ব্যাংকটি বেসরকারি খাত এবং ব্যক্তিপর্যায়ে আর্থিক লেনদেন কমে আসার মতো বাধার মুখোমুখি হয়। সরকার সমর্থিত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কর্পোরেশনগুলোই ব্যাংকটির মূল আমানতকারী হিসেবে রয়ে গেছে।
বেসিক ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থার অবনতি ব্যাংকের আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধানকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আনিসুর রহমান প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে প্রতিবছর এক হাজার কোটি টাকার বেশি সুদ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা এবং তিন হাজার কোটি টাকার সচল ঋণ থেকে মাত্র ৩০০ কোটি টাকা আয়ের কথা উল্লেখ করে বর্তমান কঠোর আর্থিক পরিস্থিতির ওপর মনোযোগ আকর্ষণ করেন। এ বৈষম্যের ফলে ব্যাংকটির ৭০০ কোটি টাকার উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানের ফলাফলের প্রতিক্রিয়ায় আনিসুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ব্যাংকের টিকে থাকা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের বর্তমান লক্ষ্য হচ্ছে বকেয়া ঋণ আদায় এবং ব্যয় ব্যবস্থাপনার উন্নতি করা।'
বেসিক ব্যাংককে টিকিয়ে রাখার জন্য আনিসুর একটি দ্বৈত পদ্ধতির পরামর্শ দেন। প্রথমত, তিনি সরকারের মেগা-প্রকল্পের সমর্থনের ভিত্তিতে অল্প সুদে আমানত সুরক্ষিত করার ওপর জোর দেন। দ্বিতীয় প্রস্তাবে বাজারের ৮–৮.৫ শতাংশ হারের চেয়ে উল্লেখযোগ্য কম ২–৩ শতাংশ সুদহারসহ ১০ হাজার কোটি টাকা আমানত পাওয়ার লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন, দ্বিতীয় কৌশলে ব্যাংকটি বার্ষিক ৫০০ কোটি টাকা সুদ পাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও যা আছে
২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের সুদ আয় ৬২২ কোটি টাকার বিপরীতে সুদ ব্যয়ের পরিমাণ ৮৬৯ কোটি টাকা। ওই বছর ব্যাংকটির নিট লোকসানের পরিমাণ ছিল ২৪৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকটির সংস্থানপূর্ব ক্ষতির পরিমাণ চার হাজার ২২৫ কোটি টাকা। বকেয়া ঋণ আদায়ের এ ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকটির পুঞ্জীভূত ক্ষতির পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রায় ১৬ বছর সময় লাগতে পারে।
২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মোট আমানত ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমে ১৪ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা এবং মোট ঋণ ও অগ্রিম ৯৮৫ কোটি টাকা কমে ১৩ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা হয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাত হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দুই হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ছাড় না পেলে এর পরিমাণ দাঁড়াত সাত হাজার ৩৮৬ কোটি টাকায়।
তবে ব্যাংকটির বকেয়া ঋণ আদায় আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে বেড়েছে ১১৮ কোটি টাকা।
এমডি আনিসুর রহমান বলেন, ২০২৩ সালের অনিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকটির আমানত, ঋণ ও অগ্রিম এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, 'ব্যাংকটি আমানত সংগ্রহ বৃদ্ধি, ঋণদান কার্যক্রম সম্প্রসারণ করে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাড়ানোর মাধ্যমে বর্তমান ঋণাত্মক ধারাকে ধনাত্মক ধারায় রূপান্তরের মাধ্যমে আয় বাড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে লাভজনক পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে এবং মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস করতে পারে।'
আনিসুর রহমান বলেন, 'পরিমাণ নির্বিশেষে আমরা কোনো চেক প্রত্যাখ্যান করিনি। তবে দীর্ঘস্থায়ী লোকসানের কারণে সাধারণ আমানতকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। আমরা ৮ শতাংশের বেশি সুদহারে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করি। ফলে ব্যাংকের তহবিল ব্যয় অনেক বেশি।'
পরিচালন ব্যয় কমাতে বেসিক-এর উদ্যোগ
আর্থিক সমস্যার প্রতিক্রিয়ায় বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় সাশ্রয়ী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। এর অংশ হিসেবে ব্যাংকটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য স্বল্প সুদে গৃহঋণ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছিল। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির পর এখন এ ঋণ সেবা পুনরায় চালু করেছে এটি।
২০২১ সালের এপ্রিলে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুর রহমান ব্যাংকের ১৩৩টি গাড়ির মধ্যে ৬৫টি বিক্রয়সহ ব্যয় সাশ্রয়ের বিভিন্ন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেছেন। এছাড়া একই উদ্দেশ্যে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের আয়তন পাঁচ তলা থেকে কমে তিন তলা করা হয়েছে। বিভিন্ন সেবা ফি এবং কমিশনের মাধ্যমে এখন ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় মেটানো হচ্ছে।
অন্যদিকে আব্দুল হাই বাচ্চুর সময়কালে জালিয়াতি করে ভুয়া জামানতে দেওয়া ঋণের বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে, বাকিটা খেলাপি হয়ে আছে।
বর্তমান বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে গত প্রায় তিন বছরে বকেয়া ঋণের ৯০০ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। নিট লোকসানের পরিমাণও এবং মূলধন ঘাটতি দুটোই আগের চেয়ে কমেছে।
এসব সূচকে অগ্রগতি হলেও ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতি এখনও বেশ নাজুক। ব্যাংকটির তারল্য পরিস্থিতি বর্তমানে বেশ খারাপ অবস্থায় রয়েছে, আমানত আগের বছরের তুলনায় কমেছে।
বেসিক ব্যাংকের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ৬১টি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। চার্জশিট হওয়ার কারণে ঋণগ্রহীতাদের ব্যাংকটির সঙ্গে সমঝোতার আগ্রহ কমে গেছে বলে জানান ব্যাংকারেরা।
আনিসুর বলেন, ডলার সংকটের এ সময়ে বেসিক ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার না নিয়েই স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তিনি আরও বলেন, গত বছর রপ্তানির দিক থেকে বেসিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংককে ছাড়িয়ে গেছে। যেখানে সোনালী ব্যাংক রপ্তানি করেছে দুই হাজার কোটি টাকার, যেখানে বেসিক ব্যাংকের রপ্তানি ছিল আড়াই হাজার কোটি টাকার।
কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি
বাচ্চুর আমলে ব্যাংকটির ঋণ পোর্টফোলিও এটির আমানতের পরিমাণকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এতে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল মৌলিক ব্যবস্থাপনার ওপর। তবে ২০২২ সালের শেষের দিকে ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত আগের বছরের ৯৬ শতাংশ থেকে কমে ৯০ শতাংশে নেমে এসেছে।
২০২২ সালে আমদানি অর্থায়নে ৬ দশমিক ৭২ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ব্যাংকটি রপ্তানি অর্থায়নে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখেছে।
একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি উপযুক্ত স্তর বজায় রাখতে গৃহীত ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমদানি অর্থায়নের হ্রাস ইচ্ছাকৃত ছিল।
তারপরও ব্যাংকটির রপ্তানি অর্থায়ন আগের বছরের তুলনায় ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়ে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ দুই হাজার ৯৩১ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
এছাড়া ব্যাংকের পরিচালন কর্মক্ষমতায়ও উন্নতি দেখা গেছে। ফলে ২০২১ সালের তুলনায় ২৭৪ কোটি টাকা পরিচালন লোকসান হ্রাস পেয়েছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটির পরিচালন ক্ষতি ছিল ১২৮ কোটি টাকা।