অবলোপনকৃত ঋণ সবচেয়ে বেশি আদায় করেছে জনতা, সবচেয়ে কম বেসিক
গত বছর ছয়টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক তাদের অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নিয়েছিল। তবে তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। গত বছর ব্যাংক ছয়টি মাত্র ২৫৪ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৪ শতাংশ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবলোপনকৃত ঋণ আদায় করেছে জনতা ব্যাংক। গত বছরে লক্ষ্যমাত্রার ২৭ শতাংশ বা ৮৭.৬৮ কোটি টাকা আদায় করেছে ব্যাংকটি। অন্যদিকে আর্থিক সংকটে জর্জরিত বেসিক ব্যাংক ২০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মাত্র ৫ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে।
২০২৩ সালে সোনালী ব্যাংকের অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০০ কোটি টাকা, কিন্তু ব্যাংকটি আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৫৯ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংক তাদের ৪০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫৬ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংক তাদের ৬০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৩.৪৮ কোটি টাকা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। আর ৩০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিডিবিএল ৩৩ কোটি টাকা আদায় করেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, অকার্যকর আদায় প্রক্রিয়া, সীমিত আর্থিক ও মানব সম্পদ, আইনি জটিলতা ইত্যাদি কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো অবলোপনকৃত ঋণ তেমন একটা আদায় করতে পারেনি।
এক বছরে সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী, বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংকের লিখিত ঋণ বেড়েছে ৩৭ কোটি টাকা। এই বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা কমবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্যাংকাররা বলছেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশে নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। ব্যাঙ্কগুলি এনপিএল কমাতে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করছে, যার মধ্যে একটি হল ঋণ বন্ধ করা।
এক বছরের ব্যবধানে সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী, বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংকের ঋণ অবলোপন বেড়েছে ৩৭ কোটি টাকা। এর ফলে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা কমে যাবে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংকাররা বলছেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে দেশের খেলাপি ঋণ এখন সর্বোচ্চ অবস্থানে। এসব খেলাপি কমানোর জন্য নানা পদ্ধতি অবলম্বন করছে ব্যাংকগুলো। তার মধ্যে ঋণ অবলোপন একটি।
ঋণ অবলোপনের ফলে ব্যাংকের নিট মুনাফা কমে যায়। এসব ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয় বলে জানান তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালের শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ৬ ব্যাংকের ঋণ অবলোপনের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫০ কোটি টাকায়।
২০২৩ সালের শেষে সোনালী ব্যাংকের অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৬১১ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৩ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৫৬৭.৬৩ কোটি টাকা, বিডিবিএলের ১ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা এবং বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকিং খাতে অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা
সেপ্টেম্বর শেষে পুরো ব্যাংক খাতের অবলোপনকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক ২০২২ সালে অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ১০৬ কোটি টাকা আদায় করেছে। জনতা ব্যাংকে ১১২ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংক ৬৮ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংক ১১ কোটি টাকা, বিডিবিএল ১১ কোটি টাকা এবং বেসিক ব্যাংক ২৯ কোটি টাকা আদায় করেছে। .
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমাতে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। ওই রোডম্যাপ অনুসারে, কোনো ঋণ তিন বছরের পরিবর্তে দুই বছর 'মন্দ' হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হলেই তা অবলোপন করে ব্যাংকের ব্যালান্সশিট থেকে বাদ দেওয়া যাবে। এ উপায়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ কমানো হবে বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম ছিলো, ব্যাংকের মন্দমানের ঋণ ৩ বছর ধরে আদায় না হলে তা ব্যাংকের মূল ব্যালান্স শিট থেকে আলাদা করে অন্য একটি লেজার বুকে সংরক্ষণ করা হয়। এর আগে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন এবং অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা করতে হয়। ব্যাংকিং পরিভাষায় যা ঋণ অবলোপন বা রাইট-অফ নামে পরিচিত। এভাবেই ২০০৩ সাল থেকে ঋণ অবলোপন করে আসছে ব্যাংকগুলো।
ঋণ অবলোপনের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাসের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এখন অবলোপনের এই সিদ্ধান্তে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে বাড়ুক। তবে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক খাতকে ভালো রাখতে দুই বছরে ঋণ অবলোপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'ঋণ দেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন না করার কারণে আজ এই অবস্থা। ওপর মহলের চাপে ঋণ দিয়ে এখন সেই টাকা আর আদায় করতে পারছে না ব্যাংক। এখন ব্যাংক খাত বাঁচাতে হলে তাদের [ঋণ খেলাপি] বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় ঋণখেলাপি, পুনঃতফসিল ও অবলোপনের মতো উচ্চ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বাড়তেই থাকবে।'
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পুনঃতফসিল ও অবলোপন সুদ মওকুফ খারাপ সংস্কৃতি। 'এ অবস্থায় খেলাপি কমবে, কিন্তু ব্যাংকের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে না। এখানে লুকোচুরি করা উচিত নয়। যা ঘটে, তা-ই প্রকাশ করতে হবে। তাতে নীতিমালা কার্যকর হচ্ছে না, তা বোঝা যাবে,' বলেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা—যা মোট ঋণের ৯.৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২১.৭০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭.০৪৪ শতাংশ।