বগুড়া থেকে গত বছর রপ্তানি আয় কমেছে ৪০ শতাংশ
গত কয়েক বছরের তুলনায় গত বছর বগুড়া থেকে পণ্য রপ্তানি আয় ৪০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। যেখানে ২০২১, ২০২০ ও ২০১৯ সালে রপ্তানির মাত্রা ছিল উল্লেখযোগ্য। ব্যবসায়ীরা এই মন্দার জন্য রপ্তানিযোগ্য পণ্য কমে আসা, ডলার সংকট ও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ী করেছেন।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) তথ্যমতে, ২০২২ সালে বগুড়া থেকে রপ্তানি হয়েছে ৫ কোটি ৭২ লাখ ২৩ হাজার ৪৭৯ মার্কিন ডলারের পণ্য। ২০২৩ সালে রপ্তানি হয়েছে ৩ কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার ৫৫৫ ডলারের পণ্য। সে হিসাবে গত বছরে বগুড়া থেকে রপ্তানি আয় কম হয়েছে ২ কোটি ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৯২৪ কোটি ডলার (প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা)।
উত্তরবঙ্গের এই জেলা থেকে ২০২১ সালে ৫ কোটি ৮৩ লাখ ১৩ হাজার ৭৮৮ ডলার মূল্যের, ২০২০ সালে ৫ কোটি ২৬ লাখ ২১ হাজার ৯৪ ডলার ও ২০১৯ সালে ৭ কোটি ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৩২ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
বিসিসিআইর সহ-সভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বগুড়ার পণ্য রপ্তানি হতো। কিন্তু ২০২৩ সালে কেবল ভারতে পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০২২ সালে বগুড়া থেকে ১২ ধরনের পণ্য রপ্তানি হলেও গত বছর হয়েছে মাত্র সাত ধরনের পণ্য।' এই পরিস্থিতির জন্য বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও ডলার সংকট দায়ী বলে মনে করেন তিনি।
রপ্তানি পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফেরাতে হলে পণ্যের গুণগত মান বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, ব্যবসার ক্ষেত্রে নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনতে হবে।
বগুড়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন, বগুড়া উত্তরের প্রাণকেন্দ্র। বগুড়ায় তৈরি অনেক পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি কোটি কোটি টাকা আয় করা হচ্ছে। কোনো বছর বেশি কোনো বছর কম। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হওয়া খুবই জরুরি। যেমন বগুড়ায় বিমানবন্দর হলে এই অঞ্চলে বহু দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। একইসঙ্গে তখন রপ্তানি খাতও আরও গতিশীল হবে। আরও সচল হবে অর্থনীতির চাকা। বাড়বে মানুষের কর্মসংস্থান।
রপ্তানিযোগ্য পণ্যের পরিমাণ কমেছে
বিসিসিআইর ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর সাত ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে ব্যবসায়ীরা। যেখানে ২০২২ সালে ১২ ধরনের এবং ২০২১ সালে ১৬ ধরনের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে যেসব পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাইস ব্রান অয়েল, পাটজাত দ্রব্য, সেচপাম্প ও মোটরপার্টস। কিন্তু এর আগের বছরে বগুড়া থেকে ওয়েল ফিল্টার, এয়ার ফিল্টার, সবজি, সয়াবিন, গার্মেন্টস পণ্য বা তৈরি পোশাক, জালি টুপি, হস্তশিল্প পণ্য, ডিজিটাল স্কেল, টিউবওয়েল, নকশিকাঁথা, পাবদা ও শিং মাছ রপ্তানি তালিকায় ছিল। ক্রমেই বগুড়া থেকে রপ্তানি পণ্যের তালিকা কমে যাচ্ছে।
গত বছর বগুড়ার পণ্য কেবল ভারতে রপ্তানি হয়েছে। এর আগের বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, শ্রীলঙ্কা, চীন ও জার্মানিতে রপ্তানি হয়েছে।
২০২২ সালে বগুড়ায় তৈরি ১১ হাজার ২৫০ ডলারের এয়ার ও ওয়েল ফিল্টার যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু এবার বগুড়া চেম্বারের তালিকায় এই পণ্যের নাম নেই।
জানতে চাইলে বগুড়া মটরস লিমিটেডের পরিচালক ডা. তাহমিদুল ইসলাম বলেন, 'আমরা বিশ্বমানের ফিল্টার তৈরি করে। এ কারণে বাজার ক্রমাগত বাড়ছে। দেশিয় বাজারেও চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে এবার রপ্তানি করা হয়নি। আগামীতে বিশ্ব বাজারে রপ্তানির জন্য নতুন কারখানার কাজ শুরু হয়েছে।'
বিসিসিআইর তথ্যমতে, ২০২২ সালে বগুড়া থেকে রাইস ব্রান ওয়েল রপ্তানি করা হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ওপরে। এটির প্রধান প্রধান রপ্তানিকারকগুলো ছিল তামিম অ্যাগ্রো ইন্ড্রাস্ট্রিজ, ওয়েস্টার্ন অ্যাগ্রো, মজুমদার প্রোডাক্টস ও বগুড়া মাল্টি অয়েল মিলস। তবে বর্তমানে রপ্তানির শীর্ষ তালিকায় নেই রাইস ব্রান অয়েল।
দেশে রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদনের জন্য ১৭টি মিল বা কারখানা রয়েছে। যেগুলোর বেশিরভাগই বগুড়ায়।
বগুড়া থেকে রপ্তানি তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে বগুড়ার তৈরি সেচ পাম্প। বগুড়ার রপ্তানিকারকরা বলছেন, ২০০০ সালের দিকে সেচ পাম্প রপ্তানির মধ্য বিদেশের বাজারে বগুড়ার পণ্যের যাত্রা শুরু হয়। তবে দিন দিন সেই চাহিদা কমেছে।
বগুড়ার শীর্ষ রপ্তানিকারক
বিসিসিআই সূত্র জানায়, বর্তমানে কিছু রপ্তানিকারক বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি থেকে সার্টিফিকেট অব অরিজিন নিয়ে পণ্য রপ্তানি করছে। অনেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার থেকেও সার্টিফিকেট অব অরিজিন নিয়ে পণ্য রপ্তানি করছে।
২০২৩ সালে মোট রপ্তানির পরিমাণের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে হাসান জুট মিলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি করেছে ১ কোটি ৬৬ লাখ ৯৪ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের পাটজাত দ্রব্য। ২০২২ সালেও বগুড়া থেকে এই প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রপ্তানি করেছিল। ২০২১ সালে বগুড়ার শীর্ষ রপ্তানিকারক ছিল তামিম অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। এবার প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান দ্বিতীয়।
২০২০ সালে বগুড়ার রাইস ব্রান রপ্তানিতে শীর্ষে থাকলেও মজুমদার প্রোডাক্টস লিমিটেড ২০২৩ সালের তালিকায় জায়গাই পায়নি।
এ বিষয়ে মজুমদার প্রোডাক্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিত্ত মজুমদাদেরর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
তবে বগুড়া চেম্বারের সহ-সভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ জানান, এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ঢাকায়। এ কারণে তারা সার্টিফিকেট অব অরিজিন ঢাকা থেকে নেয় এবং ঢাকা থেকেই পণ্য রপ্তানি করে। তাদের বাইরে বগুড়ার আরও দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা থেকে পণ্য রপ্তানি করে থাকে।