স্বল্পমেয়াদি প্রণোদনার চেয়ে শিল্পে কেন দীর্ঘমেয়াদি নীতিসমর্থনের জরুরি দরকার
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে, শিল্পকারখানায় ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। যার এক ধারাবাহিক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যেমন প্রতিকেজি সুতা উৎপাদনে টেক্সটাইল মিলগুলোর বিদ্যুৎ খরচ ৭৮ শতাংশ বেড়ে যায়, এতে ব্যয়বৃদ্ধির তোপের মুখে পড়েন মিল মালিকরা।
এক বছর পরে, এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম আবারো প্রতি ইউনিটে ৭৫ পয়সা বাড়িয়েছে সরকার। এতে সরকারি, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) ও ভাড়া-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের খরচ ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বেড়েছে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ, টেক্সটাইল ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ব্যয়ের বোঝা তাতে আরও ভারীই হয়েছে।
গ্যাসের দামে এই উত্থান অন্যান্য প্রতিকূলতার মাত্র একটি দিক। উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকদের – জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হওয়া, ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার ৩০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হওয়ায় মুদ্রার বিনিময় দরে অস্থিতিশীলতা, বর্ধিত সুদহার, ও মজুরি বৃদ্ধির মতোন বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে খর্ব হয়েছে বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা, অথচ কম উৎপাদন ব্যয়ের সুবাদেই আগে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগীদের চেয়ে কম দরে পণ্য রপ্তানি করা যেত।
সামনে ২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের (এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন) সম্ভাবনা রয়েছে, এনিয়েও শঙ্কার অন্ত নেই। কারণ, গ্র্যাজুয়েশনের পর পশ্চিমা দেশগুলোর বাজারে শুল্ক-মুক্ত প্রবেশাধিকার হারাতে পারে বাংলাদেশ। তার আগে ধাপে ধাপে নগদ সহায়তা প্রত্যাহারের বিষয়টিও আশঙ্কার মেঘ জড়ো করছে। এই পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রয়ের ওপর নির্ভরশীল উৎপাদনকারীদের জন্য সম্ভাব্য এক মারাত্মক আঘাত।
অপ্রত্যাশিত এবং অস্থিতিশীল নীতিগুলোই সবচেয়ে খারাপ
দেশের অর্থনীতিতে নানান অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি পথও রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো– এক দশক বা তার বেশি সময় কার্যকর থাকবে এমন নিশ্চিত ও স্থিতিশীল নীতি কার্যকর করা। তা নাহলে– জ্বালানির আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি ও প্রণোদনা হ্রাসের চেয়েও বড় ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় চট্টগ্রাম-ভিত্তিক ওয়েল গ্রুপের ঘটনা। ২০১৭-১৮'তে তারা একটি কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল স্থাপন ও খাদ্যখাতের নিজস্ব ব্যবসা সম্প্রসারণে ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। শিল্পোৎপাদনে ব্যবহারের জন্য সরকার এলএনজি অবকাঠামো নির্মাণ করার পর– নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের সুবিধা পাওয়া যাবে– এমন ধারণার ভিত্তিতে তারা এ পদক্ষেপ নেয়।
কিন্তু, কোভিড-১৯ মহামারির শুরুতে আকস্মিকভাবেই কারখানার বন্ধ রাখতে হয়। মহামারির ক্ষতিকর প্রভাব কমে আসায় যখন পুনরুদ্ধার সম্ভাবনাময় হবে মনে হচ্ছিল – তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বাড়তে থাকে – খাদ্য, জ্বালানি থেকে শুরু করে কাঁচামালের দাম। এতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়, এবং ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ৩০ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটে।
২০২১-২২ অর্থবছরে ডেফারড এলসির মাধ্যমে প্রতি ডলারের দাম ৮৬-৮৭ টাকা দিয়ে কাঁচামাল আমদানি করে ওয়েল গ্রুপ। তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদিত পণ্যের দামও নির্ধারণ করে। কিন্তু, এক বছর পরেই, ১১০/১১৫ ডেফারড এলসিগুলোর মূল্য পরিশোধের সময় ব্যয় অনেকগুণ বাড়ে তাদের, যখন প্রতি ডলারে দিতে হয়েছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। এতে তাদের বড় লোকসান হয়েছে।
মুদ্রার দর ওঠানামার চেয়েও অনেক গভীর বর্তমান সময়ের প্রতিকূলতাগুলো। ২০২৩ সালে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম বড় হারে ১২ টাকা থেকে ৩০ টাকা করার সিদ্ধান্তে আকস্মিক আঘাত আসে, যারজন্য প্রস্তুত ছিলেন না ব্যবসায়ীরা। ওয়েল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, "পরে গ্যাসের দাম যে এতটা বাড়বে, সে সম্পর্কে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না।"
এজন্য কর হারে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামকে বিস্তৃত করা, সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং ব্যয় বিশ্লেষণের জন্য অপরিহার্য নীতিগত সামঞ্জস্য বিধানের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
ওয়েল গ্রুপের দুরবস্থা ব্যবসায়ীক প্রবণতার সার্বিক চিত্র তুলে ধরছে, যেখানে টেক্সটাইলসহ অন্যান্য খাতের কারখানা মালিকেরা নীতিগত নিশ্চয়তা না থাকায় একই রকম সমস্যার মধ্যে রয়েছেন।
ইসরাক টেক্সটাইল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ফজলুল হক বলেন, "আমরা প্রণোদনা চাচ্ছি না; বরং ১০-১৫ বছর স্থায়ী হবে এমন দীর্ঘমেয়াদি ও স্থিতিশীল নীতি চাই। এতে আমাদের ওপর প্রযোজ্য কর হার ও ইউটিলিটি (গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদির) মূল্যের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।"
"এ ধরনের নীতির আলোকে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করা যায় কিনা–উদ্যোক্তারা সে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন"- বলছিলেন ফজলুল হক, তিন বছর আগে যিনি একটি টেক্সটাইল মিল স্থাপনে ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। বর্তমানে সুতার তেমন চাহিদা না থাকা ও গ্যাসের বাড়তি দামের কারণে মিলটি বলতে গেলে অচল, অন্যদিকে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের সুদ বেড়ে চলছে। ফলে প্রতিকূলতাই বাড়ছে তাঁর।
গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হওয়া এবং দাম বাড়ানোর এই পরিণতি শুধু ফজলুল হকের জন্যই দুর্ভোগ বয়ে আনেনি। বিটিএমএ'র ভাইস প্রেসিডেন্টের মতে, ২০২১-২২ এ টেক্সটাইল খাতে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগে করা মিলের অধিকাংশ, এবং পুরোনো মিলগুলোর প্রায় অর্ধেক এখন লোকসান দিচ্ছে।
২০২৩ সালের সালের মে মাসে বিদেশি ঋণের সুদের উপর ২০ শতাংশ করারোপের ঘটনাতেও– বাংলাদেশে নীতির অনির্দেশ্যতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। এই আকস্মিক পরিবর্তনটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আগের নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। যেখানে ১৯৭৬ সালে জারি করা একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিদেশি ঋণের সুদের উপর কর মওকুফ করা হয়েছিল।
দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার মন্তব্য করেন, "এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা মোটেও ভালো হয়নি, বিশেষত যখন এটি করা হয়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র ঘাটতির সময়ে।"
টেক্সটাইল, পোশাক, সিরামিক, ওষুধসহ নানান খাতে ব্যবসা রয়েছে ডিবিএল গ্রুপের। গত এক দশকে তাদের ব্যাপক সম্প্রসারণও হয়েছে। যার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল– ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট এবং জার্মান ঋণদাতাদের থেকে নেওয়া স্বল্প সুদের বৈদেশিক ঋণ।
২০২২২ সালে আন্তর্জাতিক উন্নয়নে অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর থেকে ৯৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় ডিবিএল গ্রুপ। বিদেশি ঋণের ওপর কর আরোপের পর শিল্পগোষ্ঠীটি টিবিএসকে জানায়, এখন থেকে বিদেশি ঋণ নেওয়ার আগে তাদের আরও ভাবনা-চিন্তা করতে হবে।
পরবর্তীতে, বিদেশি ঋণের সুদে কর অব্যাহতির মেয়াদ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করেছে এনবিআর।
ব্যবসার টিকে থাকার জন্য চাই সুস্পষ্ট দীর্ঘমেয়াদি নীতি
বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি নীতি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আরো জরুরি কেন হয়ে পড়েছে, তা ব্যাখ্যা করে জব্বার বলেন, আগে সস্তা শ্রম, জ্বালানি ও বিদ্যুতের তুলনামূলক কম দাম ও প্রণোদনা পেতেন ব্যবসায়ীরা; যা তাদের কর ও জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির মতোন আকস্মিক নীতি পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সহায়তা দিত।
"কিন্তু জ্বালানি ও শ্রমিকের মজুরি বাড়তে থাকায় সেই সুযোগ এখন কমে আসছে। তাছাড়া, ২০২৬ সালে আমাদের এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরে অনেক বাজারেই আমরা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার হারাব। তাই এখন থেকে সুস্পষ্ট তথ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালার দরকার – তা সেটা কর হারের ক্ষেত্রেই হোক, বা ইউটিলিটি সেবার মূল্য নিয়ে। ব্যবসাবাণিজ্যের টিকে থাকা এবং নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা– উভয়ের জন্যেই এটি অপরিহার্য"- টিবিএসকে বলেন তিনি।
স্থানীয় চিন্তক সংস্থা– সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, নীতিমালার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচ্চ মাত্রার ঘাটতি রয়েছে। "এর (নীতি) আগে থেকে অনুমান করা যায় না, সেটা কর হারের ক্ষেত্রেই হোক বা সেবার মূল্যের ক্ষেত্রে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই শিক্ষক আরো বলেন, "বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বলেন বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ অনুমানযোগ্য নয়।" মজুরি কমিয়ে রেখে আর উন্নয়ন করা যাবে না। অল্পসংখ্যক কিছু শিল্প ছাড়া প্রায় সব শিল্পের কার্যকরী বিনিয়োগ পরিকল্পনার জন্য একটি বিস্তৃত নীতি কাঠামোর দরকার।
তিনি বলেন, "দেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরিপ্রেক্ষিতে অনুমানযোগ্য নীতি এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ বাংলাদেশের আরও প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের জন্য শুধুমাত্র পোশাক খাত নয়, অন্যান্য খাতের মাধ্যমেও রপ্তানি ঝুড়িতে পণ্য-বৈচিত্র্য আনতে হবে।"
ভিয়েতনামের সাথে তুলনা দিয়ে অধ্যাপক রায়হান বলেন, ধারাবাহিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতির সুবাদে দেশটি অসাধারণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। দেশটির পণ্য রপ্তানি ৩০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, এবং বছরে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, নীতির ধারাবাহিকতা না থাকার কারণে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে।