রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণ আদায়ে পিছিয়ে জনতা ও অগ্রণী
দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকের মধ্যে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছে সোনালী ও রূপালী ব্যাংক। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ আদায়ে পিছিয়ে রয়েছে অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, কিন্তু ব্যাংকটি আদায় করতে পেরেছে মাত্র ২২৫ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ১৪.৮৫ শতাংশ। গত বছর অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা; ব্যাংকটি আদায় করতে পেরেছে ৩৮৯ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ২৫.৩৪ শতাংশ।
২০২৩ সালে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটি এর বিপরীতে আদায় করতে পেরেছে ৫৬৭ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ৫৬.৭০ শতাংশ।
অন্যদিকে একই সময়ে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহক থেকে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯২০ কোটি টাকা। ব্যাংকটি এই সময়ে এসব গ্রাহকদের থেকে ঋণ আদায় করতে পেরেছে ৫০৭ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ৫৫.১১ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, খেলাপি ঋণ ও অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বার্ষিক এমওইউ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ঋণ আদায়ে সর্বদা ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষণে রেখেছে।
'অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ এখন খুবই কঠোর হচ্ছে খেলাপি গ্রাহকদের ঋণ আদায়ে, যার কারণে খেলাপি ঋণ আদায় বেড়েছে,' ওই কর্মকর্তা বলেন।
রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমি রূপালী ব্যাংকে এমডি হিসেবে যোগদানের পর খেলাপি ঋণ আদায় করতে বিশেষ সেল গঠন করেছি। একইসঙ্গে প্রতি মাসে এই সেলের সদস্যদের নিয়ে সভা করছি। আমাদের বিশেষ তদারকি বৃদ্ধি পাওয়ায় খেলাপি ঋণ থেকে আদায় বাড়ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি ব্যক্তিগতভাবে শীর্ষ খেলাপিদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। অনেক গ্রাহককে বোঝাতে সক্ষম হয়ছি, তাদের ঋণ পরিশোধ করতেই হবে।'
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ টিবিএসকে বলেন, 'খেলাপি ঋণ আদায় করতে শাখা থেকে হেড অফিস পর্যন্ত ফোর-টিয়ার ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে। প্রতিটি শাখার ম্যানেজারকে প্রত্যেক শাখায় শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের ঋণ আদায়ে জোরদার ভুমিকা রাখার নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক ডিএমডিকে এক একটি বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যার কারণে খেলাপি ঋণ আদায়ে সুফল পাচ্ছি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের ঋণের প্রবৃদ্ধিও অনেকটা ভালো। আমাদের ব্যাংকে এখন সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছি সুশাসন নিশ্চিত করতে। আমাদের প্রায় ১৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ থেকে ১৩ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমাতে রোডম্যাপ তৈরি করেছে জানিয়ে সোনালী ব্যাংক এমডি বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য রয়েছে ২০২৬ সালের মধ্যে আমাদের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নিচে নামিয়ে আনব।'
মোট খেলাপি ঋণ ১.৪৫ লাখ টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১.৪৫ লাখ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ২১ শতাংশ।
দেশের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অনুপাত সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ২৬ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ১৯.২০ শতাংশ। এদিকে রূপালী ও সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা এবং ১৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক দুটির নিজ নিজ মোট ঋণের ১৭.৮১ শতাংশ ও ১৪.১৩ শতাংশ।
ব্যাংকগুলোর সার্বিক মনিটরিং নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। ব্যাংকে জালিয়াতি ও প্রতারণা কমাতে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০২৩ সালে অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে এগিয়ে রয়েছে জনতা ও রূপালী ব্যাংক। দুটি ব্যাংক তাঁদের লক্ষ্যমাত্রার যথাক্রমে ২৩.৬৪ শতাংশ ও ২১.৬৭ শতাংশ আদায় করেছে। তবে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের আদায়ের পারফরম্যান্স ছিল যথাক্রমে ১২ শতাংশ ও ১৪ শতাংশ।
জনতা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'সাধারণত অবলোপনকৃত ঋণগুলো থেকে আদায়ের নিশ্চয়তা খুবই কম থাকে। তারপরও আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আদায় করতে সক্ষম হয়েছি।'
সাধারণত ব্যাংকগুলো মন্দ মানের খেলাপি ঋণগুলোকে অবলোপন করতে পারে। তবে এর জন্য ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশনিং করতে হয়। অর্থাৎ ১০০ টাকা অবলোপন করতে হলে ১০০ টাকা প্রভিশনিং করতে হয়।
২০২৬ সালের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে রোডম্যাপে ১৭টি পদক্ষেপ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে অন্যতম পদক্ষেপ হচ্ছে, অবলোপনের সময় ৩ বছর থেকে ২ বছরে নামিয়ে আনা। অর্থাৎ এখন খেলাপি ঋণ দুই বছরেই অবলোপন করা যাবে। ব্যাংকগুলো এই সুযোগ নিতে পারলে তাদের খেলাপি ঋণ প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা কমে যাবে।