যে কারণে মাত্র একমাসে ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ১৫,০০০ কোটি টাকা
ব্যাংকখাতে ক্যাশ এক্সেস লিকুইডিটি বা অতিরিক্ত তারল্য প্রায় ১৫,০০০ হাজার কোটি টাকা কমে চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে ৫,১৫৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে; যা গত একমাস আগেও ছিল ১৯,৯৬৬ কোটি টাকা।
মাত্র একমাসের ব্যবধানে যে পরিমাণে ক্যাশ তারল্য কমেছে, তা গত কয়েক বছরে হয়নি বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। তারা জানিয়েছেন, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে অর্থ ইনজেক্ট করায় পরিমাণে এমন তারতম্য দেখা দিয়েছে।
ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকের আমানতের বিপরীতে ৪ শতাংশ ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকগুলোর কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই রিকয়ারমেন্টের চেয়ে বেশি নগদ থাকলে সেটাকে ক্যাশ এক্সেস লিকুইডিটি বা অতিরিক্ত তারল্য বলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছর ধরে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ হাজার কোটি টাকার কাছে উঠানামা করছে। তবে হঠাৎকরেই ডিসেম্বর শেষে এটি প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকা হয়ে যায়।
ব্যাংকাররা বলছেন, কয়েকটি ইসলামী ধারার ব্যাংকে গত এক বছর ধরে সিআরআর ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া, কিছু ব্যাংকের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা কারেন্ট অ্যাকাউন্টেও ঘাটতি রয়েছে।
"২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যালেন্স সিট ঠিক রাখার জন্য এসব ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ বিবেচনায় তারল্য সুবিধা দিয়েছে, যার কারণে সাময়িক সময়ের জন্য ব্যাংকগুলো ক্যাশ এক্সেস তারল্য ছিল," বললেন ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা।
২০২৪ সালের জানুয়ারি শেষে সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে বিদেশি ব্যাংকের ২,১১৮ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকের ১,৪৯৫ কোটি টাকা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৯২৫ কোটি টাকা এবং শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের মাত্র ৫৯৩ কোটি টাকা।
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৫টি ব্যাংকের সিআরআর ঘাটতিতে রয়েছে প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকার মতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের আগস্ট শেষে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ৭,৮২১ কোটি টাকা, যা একই বছরের নভেম্বরে ছিল ৫,৪২৯ কোটি টাকা।
গেল বছরের শেষে ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স সিট ভালো দেখাতে সংকটে পড়া ৫ ইসলামী ব্যাংকসহ ৭ ব্যাংককে মোট ২২,০০০ কোটি টাকার জরুরি তহবিল দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত ২৮ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক ৯.৭ শতাংশ সুদে তিন দিনের জন্য এই টাকা নিয়েছে।
ব্যাংকগুলোর জামানত হিসেবে দেওয়ার মতো কোনো সিকিউরিটিজ না থাকায় 'ডিমান্ড প্রমিসরি নোট' এর বিপরীতে এসব টাকা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, "আমাদের ২০২২ সাল শেষ হয়েছে ফরেন করেন্সি সংকটের মধ্যে। ২০২৩ সালে ফরেন কারেন্সি ও লোকাল কারেন্সি দুটোরই সংকট ছিল ব্যাংকখাতে। এখনও ব্যাংকগুলো তারল্য সংকট রয়েছে, যার কারণে ক্যাশ এক্সেস লিকুইডিটি তেমন একটা বাড়ছে না।"
তিনি বলেন, "কয়েকটি ইসলামী ধারার ব্যাংকের এখনো ১০,০০০ কোটি টাকার বেশি সিআরআর ঘাটতি রয়েছে। যার কারণে প্রতিদিন তাদের জরিমানা বাড়ছে। গেল বছরেও তাদের একই অবস্থা ছিল, বছর শেষে তাদের ব্যালেন্স শিট ভালো দেখানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ সুবিধায় তাদের তারল্য সুবিধা দেয়; যার কারণে তারা ব্যালেন্স শিট ভালো দেখাতে পারলেও তিন দিন পর তাদের দেওয়া তারল্য সুবিধাগুলো কেটে নেওয়া হয়।"
জানুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ১১,০০০ কোটি টাকা
ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য আগের মাসের তুলনায় জানুয়ারিতে ১১,০০০কোটি টাকা কমে ১,৫২,০০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ১,৬৩,০০০ কোটি টাকা।
প্রয়োজনীয় এসএলআর এবং সিআরআর বজায় রাখার পরে অতিরিক্ত তারল্য গণনা করা হয়। ব্যাংকগুলোর জন্য নগদ আকারে মোট আমানতের ৪ শতাংশ সিআরআর এবং নগদ-বহির্ভূত ভিত্তিতে ১৩ শতাংশ এসএলআর বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা বাধ্যতামূলক।
তবে অতিরিক্ত পরিমাণ সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা থাকে, যার মাধ্যমে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে অর্থ ঋণ নেয়।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করছে না। অনেক ব্যবসায়ী ওয়ার্কিং ক্যাপিটেল লোনগুলো টার্ম লোনে রূপান্তর করছে। এতে ব্যাংকগুলোর তারল্য ইনফ্লো হচ্ছে না।"
"এছাড়া, আমদানি ব্যাপক কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এতে কিছু কিছু ছোট প্রতিষ্ঠান ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েছে।"
"একইসঙ্গে, মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি, যার কারণে মানুষজন ব্যাংকগুলোতে আমানতও বাড়াচ্ছে না। কারণ মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতেই তাদের আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে," যোগ করেন তিনি।