ব্যাংকগুলোতে নগদ ডলারের পরিমাণ বাড়ছে
ডলার সংকটের মধ্যে দেশের ব্যাংকগুলোতে ক্যাশ ডলার হোল্ডিং বাড়তে শুরু করেছে। মূলত বাংলাদেশিদের বৈদেশিক মুদ্রার অ্যাকাউন্ট খোলা ও পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার পাশপাশি অনাবাসী বাংলাদেশি এবং বিদেশিদের জন্য সুবিধাজনক রিটার্নের বিনিময়ে ডলার জমা রাখার সুবিধার্থে অফশোর ব্যাংকিং আইন প্রণয়নের ফলে ডলার হোল্ডিং ক্রমাগত বাড়ছে।
২৪ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকে নগদ ডলারের পরিমাণ বেড়ে ৩৯.৩৯ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৩২ মিলিয়ন এবং জানুয়ারিতে ছিল ২৮ মিলিয়ন ডলার।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী রোববার (২৪ মার্চ) এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় সাম্প্রতিক অফশোর ব্যাংকিং আইন পাসের পর বিদেশি আমানতকারী এবং বিনিয়োগকারীদের আগ্রহে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
গতকাল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ (বিআইডিএস) কার্যালয়ে আয়োজিত 'আনপ্যাকিং দ্য ইকোনমিক ম্যানিফেস্টো অব আওয়ামী লীগ: ট্রেন্ডস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জস ফর টুমরো বাংলাদেশ' শীর্ষক সেমিনারে মন্ত্রী বলেন, "আমরা শীঘ্রই বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধির প্রত্যাশা করছি।"
এদিকে ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আরএফসিডি (রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট) হিসাবে জমা দেওয়া ডলারের ওপর ৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে শুরু করেছে। পাশাপাশি এই হিসাবের ডলার কোনো বাছবিচার ছাড়াই দেশে ও বিদেশে গিয়ে খরচ করা হচ্ছে। প্রতিবার বিদেশ ভ্রমণের সময় এই হিসাব থেকে নগদ ১০,০০০ মার্কিন ডলার জমা রাখার অফার ঘোষণা করেছে একাধিক ব্যাংক। এসব কারণে এখন ব্যাংকের ক্যাশ ডলার বাড়ছে।
বর্তমানে নগদ ডলারের বড় অংশ মজুদ আছে ইস্টার্ন, দি সিটি, ব্র্যাক, ডাচ্-বাংলা, প্রাইম, পূবালী, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এইচএসবিসি, ইসলামীসহ আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংকে। মার্কিন ডলারের পাশাপাশি পাউন্ড, ইউরো, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, কানাডিয়ান ডলার, সিঙ্গাপুরি ডলারেও আরএফসিডি হিসাব খোলা যায়।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগরে প্রধান টিবিএসকে বলেন, "আরএফসিডি অ্যাকাউন্টে ছাড় দেওয়ার কারণে ব্যাংকের ক্যাশ ডলার বাড়তে পারে। কারণ এখানে মানুষ এখন কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বিদেশ ভ্রমণ শেষে ১০,০০০ হাজার ডলার পর্যন্ত রাখতে পারছে। একটা মুনাফাও পাওয়া যাচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, এখন কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকের দেওয়া ডলার রেটের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। কার্ব মার্কেটে ১১৭-১১৮ টাকা পেলেও ব্যাংকগুলো প্রতি ডলারের বিপরীতে ১১৪-১১৫ টাকা করে দিচ্ছে। তাই যাদের কাছে ক্যাশ ডলার আছে, তারা ব্যাংকেই রাখছেন।
"তবে ক্যাশ ডলার বাড়লেই যে ব্যাংক সেটা বিক্রি করতে পারবে তেমন নয়। কারণ অনেকে আছেন যারা নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণ করেন, কয়েকদিন পর আবার প্রয়োজন হতে পারে, স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্টে রাখতে পারে, চিকিৎসার আগে বিদেশ যাওয়ার জন্যও রাখতে পারে। তবে এগুলো নির্ধারিত সময় পর তারা নিয়ে যাবেন। এগুলো ব্যাংকের পক্ষে বিক্রয়যোগ্য না। তাই এগুলো কতটা টেকসই ডলার আগে সেটা দেখতে হবে," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের ৩ ডিসেম্বর থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে মানুষের ঘরে রাখা ডলার ব্যাংকে ফেরাতে আবাসিক বৈদেশিক মুদ্রা আমানত বা রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) হিসাবের ওপর সুদসহ বাড়তি সুবিধা দেওয়ার সুযোগ করে দেয়।
এরপরই দি সিটিসহ কিছু ব্যাংক বাড়তি উদ্যোগ নিয়ে এই হিসাব খুলতে শুরু করে।
কাদের জন্য আরএফসিডি হিসাব
বিদেশ থেকে এসেছেন, বয়স ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে– এমন যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিক ব্যাংকে গিয়ে আরএফসিডি হিসাব খুলতে পারেন।
এক্ষেত্রে কবে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, এটি মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হলো, বিদেশ গেছেন তার প্রমাণপত্র অর্থাৎ পাসপোর্ট ও ভিসার নথিপত্র ব্যাংকে জমা দিতে হবে। হিসাব খোলার জন্য আরও প্রয়োজন দুই কপি ছবি, নমিনি, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন)।
এই হিসাবের বিপরীতে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কোনো চেক বই না দিয়ে ডেবিট কার্ড দেয়, যা থেকে খরচে কোনো অনুমোদন লাগে না।
কত ডলার জমা রাখা যাবে
একজন নাগরিক প্রতিবার বিদেশ ভ্রমণের জন্য ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত আরএফসিডি হিসাবে জমা রাখতে পারবেন। ফলে গত এক বছরে যদি কেউ ১০ বার বিদেশ ভ্রমণ করে থাকেন, তিনি চাইলে তার হিসাবে কোনো নথিপত্র ছাড়াই এক লাখ ডলার পর্যন্ত জমা দিতে পারবেন।
তবে প্রতিবার ভ্রমণের ক্ষেত্রে এর বেশি পরিমাণ ডলার জমা দিতে চাইলে তাকে বেশি ডলার দেশে আনার জন্য কাস্টমসের ঘোষণাপত্র জমা দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো এখন এই হিসাবের বিপরীতে ৭ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়, এই হিসাবে জমা অর্থের ওপর ব্যাংকগুলো বেঞ্চমার্ক রেটের সঙ্গে আরও অন্তত দেড় শতাংশ সুদ দেবে।
সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর) এখন ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। সে অনুযায়ী আরএফসিডি হিসাবে সুদহার দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ।
যা বললেন অর্থমন্ত্রী
রোববারের অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, অফশোর ব্যাংকিং আইন করার পর বিদেশি সঞ্চয়কারী ও বিনিয়োগকারীদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন পক্ষের সাথে ইতোমধ্যে অনেকে যোগাযোগ করেছে।
"বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বাংলাদেশের আইন তাদের পছন্দ হয়েছে। ফলে শীঘ্রই বাংলাদেশে বিদেশ থেকে সঞ্চয় বাড়বে, অর্থাৎ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে," বলেন তিনি।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভার বৈঠকে অফশোর ব্যাংকিং আইন-২০২৪ এর খসড়া চুড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। এই আইনে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে বিদেশিরা যে আমদানত রাখবে, তার মুনাফার ওপর কোনো ধরনের কর নেবে না সরকার। আমানতকারী যখন খুশি তার আমানত ফেরত নিতে পারবেন। এ ধরনের বেশ কিছু সুবিধা সরকার দিয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, "এক সময় কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছিল। কিছু লোক বলতে শুরু করেছিল ফরেন এক্সচেঞ্জ কোথায়? বাংলাদেশ শ্রীলংকা হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা হয়নি। বৈদেশিক মুদ্রা আসতে শুরু করেছে।"
অফশোর ব্যাংকিং দেশে আগেও ছিল। কিন্তু আইন ছিল না। আস্থার জন্য, নিরাপত্তার জন্য আইন দরকার আছে। যে কারণে সরকার আইন করেছে। মানুষ আস্থা পাচ্ছে। এখন এর ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে। আশা করা যায়, আগামীতে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে বেছে নেবে।"
অর্থমন্ত্রী বলেন, "জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার কোনো সংকট থাকবে না। এখন বাংলাদেশ পরবর্তী ধাপের জন্য এগোচ্ছে।"
সেমিনারের দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিআইডিএস কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সংস্থার মহাপরিচালক বিনায়ক সেন।
এসময় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীসহ অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন খাতের গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।