যে কারণে এবারের ঈদে লোকসানের মুখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জুতা কারখানা
ঈদের আগে প্রতিদিন ৫০০-৬০০ জোড়া জুতা তৈরি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পীরবাড়ি এলাকার সেভেন স্টার পিইউ ফুটওয়্যারের ফিটিংম্যান শফিকুল ইসলাম ও তার দুই সহযোগীর জন্য নিত্যদিনের ঘটনা ছিল। কিন্তু এবারে চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জুতা কারখানাগুলোতে এবারের ঈদে তেমন কর্মব্যস্ততা নেই। জুতা উৎপাদন চলছে অনেকটা ঢিমেতালে। মূলত কেমিক্যালের অভাবে এবার ঈদুল ফিতরের বাজার ধরতে পারেনি জুতা কারখানাগুলো। চীন থেকে আমদানি করা পলিইউরিথেন (পিউ) কেমিক্যাল যথাসময়ে না পাওয়ায় সবকটি কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ফলে পাইকারদের সব অর্ডার রাখতে না পারায় বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে কারখানাগুলো। অথচ ঈদের এই মৌসুমের জন্য বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকেন কারখানা মালিক ও শ্রমিকরা।
বর্তমানে কেমিক্যালের সরবরাহ স্বাভাবিক হলেও বাজার ধরতে না পারায় উৎপাদন অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছেন কারখানা মালিকেরা। ফলে আশানুরূপ কাজ না করতে পারায় এবার বাড়তি আয় হবে না কর্মীদের।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে শফিকুল জানান, গত বছরও শবে-বরাতের পর থেকে ২০ রোজা পর্যন্ত কাজের চাপে তার ও তার দুই সহযোগীর দম ফেলারও ফুরসত পাননি।
'কিন্তু এ বছর নিয়মিত কাজ চললেও অলস বসে আছি বলেই মনে হচ্ছে। বর্তমানে কেমিক্যালের সরবরাহ স্বাভাবিক হলেও কারখানা মালিক বাজার ধরতে না পারায় উৎপাদন অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে আশানুরূপ কাজ না করতে পারায় এবার বাড়তি আয় হবে না।'
রোমান মিয়া নামে একই কারখানার আরেক কর্মী বলেন, 'কেমিক্যালই জুতা তৈরির প্রধান উপকরণ। এটি ছাড়া কারখানাগুলোতে জুতা তৈরি করা যায় না। মেশিন চালু রাখতে কেমিক্যালের প্রয়োজন হয়। আর মেশিন যতক্ষণ চালু থাকে, ততক্ষণই শ্রমিকদের হাতে কাজ থাকে। তাই এবার কাজ কমে যাওয়ায় ঈদে যে বাড়তি টাকা আয়েরর আশা ছিল, সেটি হচ্ছে না। পরিবার নিয়ে কীভাবে ঈদ করবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।'
সংশ্লিষ্টরা জানান, কেমিক্যাল সরবরাহে এই বিলম্বের কারণে সব কারাখানায়ই উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ফলে অর্ডার পূরণ করতে না পারায় বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন কারখানা মালিকেরা।
সাধারণত ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জুতা ব্যবসা চলে। কারখানা মালিকেরাও বছরের অন্য সময় হওয়া লোকসান পুষিয়ে নেন দুই ঈদে ভালো ব্যবসা করে।
গত বছরও ঈদুল ফিতরে প্রায় ১২ কোটি টাকার জুতা বাজারজাত হয়েছিল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। বছরজুড়ে কারখানাগুলোতে কাজ যেমনই থাকুক, ঈদ মৌসুমে কাজের চাপে দম ফেলারও ফুরসত থাকে না শ্রমিকদের। এ সময়ে নির্ঘুম কাজ করে অর্ডার ডেলিভারি দিয়ে বেতনের বাইরে বাড়তি টাকা আয় করেন তারা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জুতা শিল্পের গোড়াপত্তন হয় ১৯৬৩ সালে। বর্তমানে জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৮০টি জুতার কারাখানা রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২৬টি কারখানায় জুতা তৈরি হয় মেশিনে। এসব কারখানায় কর্মরত আছেন ৩ হাজারেরও বেশি শ্রমিক।
ঈদ মৌসুমে বড় কারখানাগুলোর একেকটিতে প্রতিদিন অন্তত ১ লাখ টাকার জুতাজোড়া উৎপাদন হয়। দামে সস্তা এবং গুণগত মান ভালো হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এখানকার উৎপাদিত জুতার চাহিদা রয়েছে। প্রতি ঈদে বড় কারখানাগুলোর একেকটি ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার জুতা বাজারাজাত করে। আর ছোট কারখানাগুলো থেকে বাজারজাত করা হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার জুতা।
তবে এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শবে-বরাতের পর থেকে কেমিক্যালের তীব্র সংকটে পড়ে কারখারনাগুলো। ফলে শবে-বরাতের পর প্রায় তিন সপ্তাহ জুতা উৎপাদন ব্যাহত হয় কারখানাগুলোতে। চীন থেকে ব্যবসায়ীদের আমদানি করা কেমিক্যালের চালান ল্যাব টেস্টের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে আটকা পড়ে। অথচ এ সময়টাতেই ঈদ বাজারের জন্য পাইকারদের অর্ডার থাকে।
মূলত জুতার সোল তৈরিতে পিইউ কেমিক্যালের ব্যবহার হয়। ল্যাব টেস্ট শেষে কারখানাগুলোতে কেমিক্যাল পৌঁছায় ১০ রোজার পর। তবে ততক্ষণে ঈদের বাজার ধরার সময় পেরিয়ে যায়।
এছাড়া এবার সংকটের কারণে কেমিক্যালের দামও ঊর্ধ্বমুখী। বিগত বছর ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায় প্রতি লিটার কেমিক্যাল পাওয়া গেলেও এবার তা কিনতে হয়েছে ৪০০ টাকা দরে।
ফলে পরবর্তীতে কেমিক্যালের সরবরাহ স্বাভাবিক হলেও বাধ্য হয়েই কারখানাগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক উৎপাদন কমিয়ে দেন মালিকরা।
পাইকারদের বেশি অর্ডার না থাকায় বর্তমানে বড় কারখানাগুলোতে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার জুতা উৎপাদন হচ্ছে—যা গত বছরের তুলনায় অর্ধেকের চেয়েও কম। আর ছোট কারখানাগুলোর মধ্যে যেগুলোতে হাতে জুতা তৈরি হয়, সেগুলোর একেকটি থেকে এবার পুরো মৌসুম মিলিয়ে বাজারজাত হবে মাত্র ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার জুতা।
এ সংকট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মো. নাদিম নামে এক কারখানা মালিক জানান, যেহেতু ঈদের বাজারের চাহিদা ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে, তাই লোকসান কমাতে তিনি জুতার উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। 'এছাড়া সংকটের কারণে এবার বাড়তি দামে কেমিক্যাল কিনতে হয়েছে। এবার কারখানায় প্রায় ২০ লাখ টাকা লোকসান হতে পারে।'
অ্যাক্টিভ পিইউ ফুটওয়্যারের স্বত্বাধিকারী রাকিবুল ইসলাম বলেন, 'সাধারণত শবে-বরাতের পর থেকে ২৫ রোজা পর্যন্ত জুতা তৈরির কাজ চলে কারখানাগুলোতে। এ সময় দৈনিক প্রায় ১ লাখ টাকার কাজের অর্ডার থাকে।
'তবে এবার ১০ রোজার পর থেকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার কাজ হচ্ছে কারখানায়। যদি পুরো মৌসুম ধরতে পারতাম, তাহলে অন্তত অর্ধ কোটি টাকার ব্যবসা হতো এবার।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পিইউ ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ বলেন, 'আমরা আমাদের ব্যবসার মূল মৌসুমে কেমিক্যাল পাইনি। আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, বন্দরে ল্যাব টেস্টের জন্য কেমিক্যাল আটকা পড়ে আছে। মূলত শবে-বরাতের পর থেকেই আমাদের পাইকাররা অর্ডার নিয়ে আসতে থাকেন। কিন্তু এ সময়টাতে আমরা কোনো অর্ডার রাখতে পারিনি। এখন যে অর্ডার পেয়েছি, তাতে করে লোকসান এড়ানো যাবে না। প্রতিটি কারখানায় ২০-২৫ লাখ টাকার লোকসান হবে।'
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কেমিক্যাল অ্যাসিসটেন্ট হেলাল হাসান টিবিএসকে বলেন, জুতা তৈরির পিইউ কেমিক্যাল সাধারণত চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। প্রতিদিন অন্তত ১০০ নমুনা পরীক্ষা করা হয়। 'কিন্তু রাসায়নিক পরীক্ষাগারে জনবল সংকটের কারণে প্রতিবেদন দিতে ২ সপ্তাহ সময় লাগে। তবে সাময়িক শুল্কায়ন হওয়া পণ্য চালানে (পণ্য খালাসের পর যেসব স্যাম্পল পরীক্ষা করা হয়) প্রতিবেদন দিতে সময় আরও বেশি লাগে।'