তিন চীনা অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে যৌথ উদ্যোগে গাড়ি তৈরি করতে আগ্রহী
চীনের তিনটি অটোমোবাইল কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থাপন করতে চায়। উৎপাদিত গাড়ি দেশের বাজারে বিপণন ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানির জন্য স্থানীয় ব্যবসায়িক অংশীদারও খুঁজছে তারা।
চীনের এসব কোম্পানির প্রতিনিধিসহ আনহুই প্রাদেশিক গণ-কংগ্রেসের ১৭ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে এসে গত ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভায় তাদের এই বিনিয়োগের আগ্রহের কথা জানান।
চেরি অটোমোবাইল কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) কারখানা স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করে, আর জিয়াংহুয়েই অটোমোবাইল কোং লিমিটেড এবং ফোটন মটরস ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাস প্রস্তুতকারক কারখানা স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় বিসিসিসিআই।
এছাড়া ফর্কলিফট উৎপাদনে বিশেষায়িত আরেকটি চীনা কোম্পানি– হেলি বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের সাথে যৌথভাবে এদেশে একটি কারখানা স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
একইভাবে চীনের গোশান হাইটেক কোম্পানি লিমিটেড উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি গবেষণা ও উৎপাদনের জন্য একটি কারখানা স্থাপন করতে চায় বলে জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ইতোমধ্যেই দুটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান– আকিজ গ্রুপ এবং এসিআই মটরস চীনা কোম্পানিগুলোর সাথে যৌথ বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
চীনা প্রতিনিধি দলটি গত ২২ এপ্রিল বাংলাদেশে আসে। জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে গতকাল বুধবার (২৪ এপ্রিল) রাতে তারা বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন।
চীনা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় চেরি অটোমোবাইল কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি ও ও লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপনে বিনিয়োগে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন আকিজ গ্রুপের পরিচালক ও বিসিসিসিআই এর পরিচালক শেখ আমিন উদ্দীন।
চীনা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মিটিং করেছেন এনার্জি প্যাক এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশিদ। টিবিএসকে তিনি বলেন, তারা চীনের জেএসি এবং হেলি কোম্পানির সঙ্গে রেফ্রিজারেটেড কাভার্ড ভ্যান, কাভার্ড ভ্যান ও স্ট্রিট লাইট ম্যাইনটেনেন্স এর কাজে ব্যবহৃত ক্রেনসহ স্পেশাল পারপাস ভেহিক্যাল উৎপাদনে কাজ করছেন। এসব যানবাহনের ডিজাইন প্রস্তুত করা হয়েছে।
হুমায়ুন রশিদ আরো বলেন, চীনের আনহুই প্রাদেশিক সরকার চায় বাংলাদেশে তাদের কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ বাড়ৃুক। এজন্য প্রতিনিধিদলের সাথে চীনের বিভিন্ন অটোমোবাইল কোম্পানির কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সফরে আসেন।
"চীনা কোম্পানির সঙ্গে আমরা ইলেকট্রিক বাস ও ইলেকট্রিক ট্রাক সংযোজন করবো। ইতোমধ্যে আমরা ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। আরও ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে" বলেন তিনি।
এছাড়া, এসিআই মটরস এর প্রধান নির্বাহী এফ. এইচ. আনসারি চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশে যাত্রীবাহী বাস ও অন্যান্য যানবাহন উৎপাদন ও সংযোজন খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে।
চীনা প্রতিনিধিদলের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলে টিবিএসকে জানান এফ এইচ আনসারি।
"চীনা কোম্পানিগুলোর সাথে যৌথভাবে আমরা ফোটন প্রি-ম্যানুফ্যাকচারিং করব। এছাড়া, একটি চীনা কোম্পানি লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদনে আগ্রহী, এসিআই মটরস তাদের সাথে যৌথভাবে লিথিয়াম ব্যাটারিও উৎপাদন করবে।"
তিনি আরো বলেন, "চেরি অটোমোবাইল কোম্পানির সাথে আমরা যৌথভাবে যাত্রীবাহী বাস উৎপাদনেও আগ্রহী।"
বিসিসিসিআই এর মহাসচিব আল মামুন মৃধা টিবিএসকে বলেন, চীনের কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজতে এসেছিল। "আকিজ গ্রুপ, এসিআই মটরসসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সভায় উপস্থিত ছিলেন। তারা চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন"- জানান তিনি।
কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি
আল মামুন মৃধা জানান, আনহুই প্রদেশের একটি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত (এগ্রো প্রসেসিং) কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা প্রতিনিধিদলে ছিলেন। তারা বাংলাদেশের কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
তবে এসব যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে চীনা কোম্পানিগুলো কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে চায়, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
বর্তমানে বাংলাদেশে চেরি ব্রান্ডের গ্যাসেলিন কার এর একমাত্র পরিবেশক এশিয়ান মোটরস্পেক্স লিমিটেড। ফোটন ব্র্যান্ডের ট্রাক এসিআই মটরস এবং জ্যাক (জেএসি) ব্রান্ডের ট্রাক এনার্জি প্যাক বাংলাদেশে সংযোজন করছে।
২০২২ সালে বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করে চীনের গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান চেরি অটোমোবাইল কোম্পানি লিমিটেড। বর্তমানে ৮০টি দেশে তাদের ব্যবসা রয়েছে। গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) দলের সদস্য সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি। এজন্য স্বতন্ত্র সেন্টার রয়েছে চীন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলে।
গত বছর বাংলাদেশে একটি বৈদ্যুতিক গাড়ির সংযোজন কারখানা স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করে চীন। আগস্টে, ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন, চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি সংযোজন প্ল্যান্ট স্থাপন করলে– একটি সম্ভাবনাময় বাজারে প্রবেশ করবে, এ থেকে বাংলাদেশও লাভবান হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের অন্তত ১৫ শতাংশ বৈদ্যুতিক যানবাহন হবে– এমন লক্ষ্য সরকারেরও রয়েছে।
রানার গ্রুপ এবং বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (বেইল) এর মতো স্থানীয় কোম্পানির পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার অটোমোবাইল নির্মাতা হুন্দাই এবং মালয়েশিয়ার প্রোটন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার কিয়াসহ ফোর-হুইলার উৎপাদনে কমপক্ষে ছয়টি অন্যান্য উৎপাদনকারীর বিনিয়োগ পাইপলাইনে রয়েছে।
বৈঠকে চীনের প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্ব দেন আনহুই প্রাদেশিক গণ-কংগ্রেসের ভাইস চেয়ারম্যান ওয়েই জিয়াওমিং। বাংলাদেশে চীনা দূতাবাসের বাণিজ্যিক কাউন্সেলর সং ইয়াং-ও সভায় উপস্থিত ছিলেন।
সুযোগ ও সম্ভাবনা দেখছেন প্রতিনিধিরা
বিসিসিসিআই এর সভায় ওয়ে শিয়াওমিং জানান, বাংলাদেশ ও আনহুই প্রদেশের মধ্যে ২০২৩ সালে ৩১৯ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রচুর সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী তারা।
প্রতিনিধিদলের বেশিরভাগ চীনের আনহুই প্রাদেশিক সরকারের প্রতিনিধি হলেও– তাদের সঙ্গে অটোমোবাইল কোম্পানির প্রতিনিধিরাও ছিলেন।
প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন– ফোর্কলিফট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক ইয়াং আংগুয়ো; হেলি ইন্ডাট্রিয়াল ভিহেক্যাল ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কো. লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক লি মিংজুন, জিয়াংহুই অটোমোবাইল গ্রুপ কোম্পানির ডিজিএম ইন জিংকে এবং জিয়াংহুই অটোমোবাইল গ্রুপ ও জ্যাক ইন্টারন্যাশনালের ডেপুটি সেক্রেটারি হুয়াং ফুদে।