বৈষম্যমূলক নীতিমালার কারণে দেশের রপ্তানি খাত বৈচিত্র্যহীন: এডিবি
আমদানি শুল্কের উচ্চহারের কারণে তৈরি পোশাক খাত বাদে দেশের বাকি রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশে উৎসাহ পায় না। মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) প্রকাশিত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুরক্ষামূলক এসব নীতির কারণে এ শিল্পসমূহ লাভের কথা বিবেচনা করে রপ্তানি বাজারের দিকে না গিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে মনোযোগ দেয়।
'এক্সপান্ডিং অ্যান্ড ডাইভারসিফাইং এক্সপোর্টস ইন বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড দ্য ওয়ে ফরোয়ার্ড' শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের নীতি রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল তুলনামূলকভাবে কম সমর্থনপুষ্ট শিল্পসমূহকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এ পরিস্থিতিকে 'নীতি-প্ররোচিত রপ্তানিবিরোধী বৈষম্য' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
এডিবি'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ পক্ষপাতের ফলে স্থানীয় রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রবৃদ্ধি সীমিত হয়েছে। ফলে এসব শিল্প দক্ষতা ও উদ্ভাবনে পিছিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশে আমদানি শুল্ক ছাড়াও আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন করের মতো অতিরিক্ত কর বসানো হয়। এতে স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা বাড়লেও রপ্তানিতে নিরুৎসাহ সৃষ্টি হয়।
দেশে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর মোট ট্যারিফ ইনসিডেন্স গড়ে ৫২ শতাংশ বলে ধারণা করা হয়। এ 'রপ্তানিবিরোধী বৈষম্য' অন্যান্য শিল্প এবং স্থানীয় বাজারে ব্যবসা করা বস্ত্র ও পোশাক শিল্পকে প্রভাবিত করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'আমদানি খাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া অভ্যন্তরীণ খাতকে লক্ষ্য করে প্রণোদিত অত্যধিক সুরক্ষানীতি রপ্তানি খাতের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে।'
'বৈদেশিক প্রতিযোগিতার বাইরে থাকা শিল্পে সম্পদ ও বিনিয়োগের অসম পরিচালনের দরুন এমনটা ঘটে। ফলে প্রতিযোগিতামূলক চাপের অভাবে এসব শিল্প দক্ষতা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে,' প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মূলত পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। ফলে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি কম বৈচিত্র্যময়। অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের আমদানি শুল্কও বেশি। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করায় শুল্ক আরও কমাতে চাপের পরিমাণ সামান্যই দেখা গেছে।
রপ্তানির চেয়ে স্থানীয় বাজার বেশি লাভজনক
টিবিএস-এর সঙ্গে আলাপকালে প্রতিবেদনটির প্রধান লেখক এবং এডিবি'র অর্থনীতিবিদ (কনসালটেন্ট) মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'আমরা দেখেছি, আমদানি পণ্যে উচ্চ শুল্কের কারণে সুরক্ষা পায় স্থানীয় বাজার। ফলে এটি রপ্তানি বাজারের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।'
তিনি আরও উল্লেখ করেন, এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশকে এর আমদানিতে শুল্ক কাঠামো যৌক্তিক করতে হবে।
সরকার শুল্ক কাঠামো এবং অন্যান্য বাণিজ্য নীতিমালাসমূহের যৌক্তিকীকরণ না করলে রপ্তানি বহুমুখীকরণ খুবই চ্যালেঞ্জিং রয়ে যাবে বলেও জানান তিনি।
কেন স্থানীয় বাজার বেশি লাভজনক
বিদ্যমান প্রণোদনা কাঠামোকে বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা অভ্যন্তরীণ আমদানি-প্রতিযোগী খাতে বিনিয়োগ করতে বেশি ঝুঁকছেন।
এডিবি'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাদুকা শিল্পে একজন বিনিয়োগকারী স্থানীয় বাজারে তার আমদানি-প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপরীতে ৫০ ডলার মূল্যের জুতার জন্য নয় হাজার ৫৬২ টাকা পাবেন, যেখানে একই বিনিয়োগকারী সে জুতা রপ্তানি করলে ছয় হাজার ২৫০ টাকা পাবেন। তার সঙ্গে ১৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা সুবিধা এবং ১০ শতাংশ অন্যান্য নীতি সহায়তাও থাকবে।
'বৃহৎ ও দ্রুতবর্ধনশীল অভ্যন্তরীণ বাজারের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের নীতি-প্ররোচিত বৈষম্য উচ্চমানের পণ্য তৈরির মাধ্যমে বিশ্ববাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উৎসাহিত করার বদলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে শক্তিশালী প্রণোদনা প্রদান করে। বর্তমানে এ বৈষম্যে ভারসাম্য আনার জন্য রপ্তানি নীতিতে কোনো তুলনামূলক সমর্থন নেই। এছাড়া যখন ব্যবসার খরচ বেশি হয়, তখন রপ্তানি খাতে জড়িত হওয়ার অনুপ্রেরণা আরও কমে যায়,' প্রতিবেদনে বলা হয়।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামীম আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন ধরে পোশাক খাতের মতো সরকারি নীতি সহায়তার কথা বলে আসছি। এ ধরনের সহায়তার মাধ্যমে আমরা আমাদের রপ্তানিকে বৈচিত্র্যময় করতে এবং নতুন বাজারে প্রবেশ করতে পারব।'
তিনি কয়েক দশক আগে পোশাক খাত সম্প্রসারণের প্রাথমিক পর্যায়ের পরিস্থিতির বিপরীতে বর্তমানে রপ্তানি পরিস্থিতি অন্যান্য শিল্পের জন্য অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠার বিষয়ে আলোকপাত করেন।
এছাড়া তিনি এডিবি'র প্রতিবেদনে উচ্চ মুনাফার কারণে স্থানীয় বাজার ক্রমশ লাভজনক হয়ে ওঠার পর্যবেক্ষণটি স্বীকার করেন। তা সত্ত্বেও তিনি পণ্যের গুণমান এবং প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা বাড়াতে বিদেশি বাজার অন্বেষণের গুরুত্বের ওপর জোর দেন।
শামীম উদ্বেগ প্রকাশ করেন, সরকার শুল্ক কাঠামোতে আকস্মিক কোনো পরিবর্তন আনলে আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল শিল্পসমূহের জন্য, বিশেষ করে আমদানিকৃত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতাকারী শিল্পের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে।
দেশের পোশাক খাতে সাফল্যে অবদান রেখেছে যা
এডিবি'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সাফল্যের জন্য কয়েকটি স্বতন্ত্র কারণকে কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে। বৈশ্বিক মাল্টি-ফাইবার ব্যবস্থা [এমএফএ] টেক্সটাইল এবং পোশাক উৎপাদন বাংলাদেশে স্থানান্তর করতে সহায়ক ছিল। ফলে পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধির জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়।'
এছাড়া বাংলাদেশের পোশাক ব্যবসায়ীরা উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ-শুল্ক অগ্রাধিকার থেকে লাভবান হয়েছেন, যা বাজারে তাদের প্রবেশাধিকার বাড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার পোশাক খাতের জন্য বিশেষভাবে নগদ প্রণোদনা, ডিউটি ড্রব্যাক ও বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট সহায়তা প্রদান করে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের সহজলভ্য শ্রম। এসব সমর্থনের ফলে গার্মেন্ট রপ্তানি-উৎপাদন দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে। পাশাপাশি সীমিত সার্বিক প্রবাহ নিয়েও তৈরি পোশাক খাত কিছু প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে, যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পুঁজি, প্রযুক্তি ও দক্ষতা এনে দিয়েছে। এসব বিষয় এ খাতের উন্নয়ন ও বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় খাতটিকে অন্তর্ভুক্তিকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
বিপরীতে দেশে তৈরি পোশাকের বাইরের খাতসমূহ একই ধরনের অবস্থা থেকে উপকৃত হয়নি। এছাড়া অন্য খাতের পণ্যের প্রকৃতি 'বর্ন-টু-এক্সপোর্ট' মডেলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না, কারণ গার্মেন্ট খাতের উৎপাদিত বিশেষ পোশাকপণ্যের তুলনায় সেগুলোর অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রাসঙ্গিকতা বেশি ছিল, এডিবি'র প্রতিবেদনে বলা হয়।
সমর্থন, বাজারে প্রবেশগম্যতা ও পণ্যের প্রকৃতির মতো পার্থক্যগুলো পোশাক খাতের বাইরের খাতগুলোকে জাতীয় বাণিজ্য নীতির অন্তর্নিহিত রপ্তানি-বিরোধী বৈষম্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যদিও পোশাক খাত এসব নির্দিষ্ট ও অনুকূল অবস্থার অধীনে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, অন্য খাতগুলো বিশ্ববাজারে প্রবেশ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে বৃহত্তর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।