অর্ডার বেড়েছে, ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় ডেনিম রপ্তানি
পণ্যের গুণমান ও টেকসই উৎপাদন প্রক্রিয়ার কারণে বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি সোর্সিং করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক খুচরা ডেনিম বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলো। অল্প বিরতির পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আগ্রহ বৃদ্ধি দেশের ডেনিম প্রস্তুতকারকদের জন্য উজ্জ্বল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রপ্তানিকারক ও তাদের সরবরাহকারীরা বলছেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তীব্র ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বৈশ্বিক ডেনিম সরবরাহ চেইন।
এসব ব্যবসার সুযোগ কাজে লাগাতে কিছু প্রস্তুতকারক তাদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এছাড়া তাদের অনেক সরবরাহকারী বাংলাদেশে নতুন অফিস খুলে কার্যক্রম সম্প্রসারিত করছে।
সোমবার ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি, বাংলাদেশ-এ (আইসিসি-বি) অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপোতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন রপ্তানিকারক এবং তাদের কেমিক্যাল, অ্যাকসেসরিজ ও কাপড় সরবরাহকারীরা।
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ডেনিম রপ্তানিকারক অনন্ত অ্যাপারেলসের বার্ষিক টার্নওভার ২০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির বলেন, তারা চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত তাদের পূর্ণ সক্ষমতায় অর্ডার বুক করেছেন। আন্তর্জাতিক বাজারের অবস্থা ধীরে ধীরে ভালো হওয়ায় ক্রেতারা বাংলাদেশে আসছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রায় এক বছর আগে অর্ডার কমে যাওয়ায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এই রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।
শরীফ আরও বলেন, মজুরি বাড়ানোর পর তাদের ওভারহেড খরচ হঠাৎ বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা এখন চ্যালেঞ্জে আছেন।
অনন্ত অ্যাপারেলস এখন দক্ষতা বাড়াতে এবং উৎপাদন খরচ কমাতে নতুন প্রযুক্তি ও অটোমেটেড যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগ করছে। এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ব্যবসা চালাতে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
এছাড়া ক্রেতারাও উৎপাদন খরচ বিবেচনা করে পণ্যের দাম ১০ থেকে ১৫ সেন্ট বাড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেন শরীফ। তবে এই সমন্বয় আগামী শরৎ মৌসুমের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে।
শরীফ জহির আরও বলেন, 'বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে কোনো যুদ্ধের প্রভাব না পড়লে অর্ডার বাড়বে। এতে পণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগও তৈরি হবে।'
এমঅ্যান্ডজে গ্রুপের পরিচালক মুনির আহমেদও অনেকটা শরীফের সুরে বলেন, তারাও পূর্ণ সক্ষমতায় অর্ডার বুক করেছেন।
বার্ষিক ২০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি টার্নওভারের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ডেনিম রপ্তানিকারক গ্রুপটি কিছু প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের জন্য ডেনিম তৈরি করে। এ ব্র্যান্ডগুলো সবসময় তাদের খরচ বিবেচনায় মূল্য পরিশোধ করে।
মুনির বলেন, 'দাম বাড়ানোর বিষয়টি সবসময় প্রস্তুতকারকদের দরকষাকষির সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।'
এক্সপো চলাকালে স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, বৈশ্বিক ডেনিমের বাজারের আকার প্রায় ৯৫ বিলিয়ন ডলার, বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশ। বাংলাদেশের বাজার হিস্যা বাড়ানোর সুযোগ আছে।
তিনি বলেন, 'শীর্ষস্থানীয় ডেনিম রপ্তানিকারক হিসেবে বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ রপ্তানির পরিমাণ বর্তমানের ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০.৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পারবে। দেশে ৪০টি ডেনিম কাপড়ের মিলসহ ডেনিম শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজে ২৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ আছে।'
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক শোভন বলেন, 'বর্তমানে ডেনিম মিলগুলো প্রায় ৬৫ শতাংশ কাপড় সরবরাহ করে, যেখানে আগে কাপড়ের জন্য সম্পূর্ণ আমদানির ওপর নির্ভর করতে হতো।'
সক্ষমতা বাড়াচ্ছে অ্যাকসেসরিজ ও কেমিক্যাল সরবরাহকারীরাও
বাংলাদেশে চীনা মেটাল ট্রিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান চেরি বাটন লিমিটেডের বার্ষিক টার্নওভার ৮ মিলিয়ন ডলার। প্রতিষ্ঠানটির বিজনেস ডেভেলপমেন্টের প্রধান মাহমুদুল হাসান বলেন, বাংলাদেশের বাজারে প্রবৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। নিজেদের কোম্পানির অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজারের সুযোগ কাজে লাগাতে তারা ২০১৯ সালে এখানে বিনিয়োগ করেছে। এর আগে তারা চীন থেকে আমদানি করত।
গত বছর তাদের ব্যবসার প্রবৃদ্ধি প্রায় ২৯ শতাংশ ছিল বলে জানান মাহমুদুল।
তিনি বলেন, 'আমরা আদমজী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে আরেকটি কারখানা স্থাপনের জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছি। কারখানাটিতে চলতি বছরের মধ্যেই উৎপাদন শুরু হবে।'
আরেক কেমিক্যাল কোম্পানি আরএনটি (বিডি) লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ ওয়াহিদুল আলম বলেন, ডেনিমের বাজার বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ডেনিমের ব্যবসা বাড়ছে তিনটি কারণে—কম দাম, গুণমান ও উচ্চ সক্ষমতা।
ডেনিম কাপড় ধোয়ার কাজে পানির ব্যবহার কমাতে স্থানীয় মিলাররা নতুন ওয়াশিং ও ডাইং প্রযুক্তি গ্রহণ আনছেন।
উদাহরণ দিতে গিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, অনেক ডেনিম মিলার এখন এক কেজি কাপড় ধোয়ার জন্য সাত থেকে আট লিটার পানি ব্যবহার করে; আগে ব্যবহার করত প্রায় ৩৫০ লিটার পানি।
ওয়াহিদুল আলম আরও বলেন, মিলারদের চাহিদা বেশি থাকায় তার ব্যবসা ১৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
বাজারের কিছু চ্যালেঞ্জ
বৈশ্বিক ডেনিম সরবরাহে বাংলাদেশ এখন চূড়া স্পর্শ করেছে। অনেক গ্রাহক ইতিমধ্যে এদেশ থেকে সোর্সিংয়ের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গেছে।
শরীফ জহির বলেন, কিছু খুচরা বিক্রেতা ইতিমধ্যেই একটি দেশের ওপর নির্ভরতা কমানোর কৌশল বাস্তবায়ন করেছে। ঝুঁকি কমাতে তারা সোর্সিং স্থানান্তর করেছে।
অন্যদিকে কিছু স্থানীয় নির্মাতাও বাজার সম্পর্কে সঠিকভাবে না জেনে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ করছে, যা আরেকটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, বলেন তিনি।
অন্যদিকে চীনা ফাস্ট ফ্যাশন খুচরা বিক্রেতা শিন অন্যান্য খুচরা বিক্রেতাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে; কারণ শিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৪-৫ ডলারে ডেনিম বিক্রি করতে পারে। তাদের সরবরাহ চেইন ঠিকমতো শনাক্ত করা যায় না। শিন কোন কারখানা থেকে পণ্য তৈরি করে, তা কেউ জানে না।
স্বভাবতই মানুষ সস্তা পণ্য কেনে। এর ফলে ফাস্ট ফ্যাশন চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে বলে মন্তব্য করেন শরীফ।
বাংলাদেশ, ভারত, চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, ভিয়েতনাম, জাপানসহ ১১টি দেশের ৬০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান দুই দিনের ডেনিম এক্সপোতে অংশ নিচ্ছে।
টেকসই কাপড় থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক ডিজাইনসহ ডেনিম শিল্পের বৈচিত্র্যকে তুলে ধরতে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সর্বশেষ উদ্ভাবন দেখাচ্ছে।