দুর্যোগকালীন ব্যয়ের জন্য ছাড় না হওয়া ঋণের ১০ শতাংশ দ্রুত দেওয়ার প্রস্তাব বিশ্বব্যাংকের
ছাড় না হওয়া ঋণের ১০ শতাংশ জরুরি বা দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য দ্রুত পাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশকে একটি নতুন ধরনের অর্থায়ন পদ্ধতির প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তাদের প্রাক্কলন অনুযায়ী, গত অর্থবছরের পাইপলাইনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ঋণের পরিমাণ বিবেচনা করা হলে দ্রুতহারে ছাড় করা এ অর্থের পরিমাণ হবে ৮৪৭ মিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরের ছাড় না হওয়া অর্থের হিসেব ধরলে এর পরিমাণ আরও বেশি হবে বলে জানান তারা।
র্যাপিড রেসপন্স অপশন (আরআরও) নাম দেওয়া নতুন এ পদ্ধতিটি বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি অনুমোদিত ক্রাইসিস প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স টুলকিটের অংশ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্বাস্থ্য ঝুঁকি বা সংঘাতের মতো সংকট তৈরি হলে বিশ্বব্যাংকের ঋণের অর্থ দ্রুত সময়ে জরুরিভাবে সাড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতে সাহায্য করা এ টুলকিটের লক্ষ্য।
২৯ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কাছে এক চিঠিতে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে তাদের এ নতুন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানিয়ে 'একটি নতুন র্যাপিড রেসপন্স অপশন চালু করার' আমন্ত্রণ জানায়।
বিশ্বব্যাংকের নতুন এ প্রস্তাব দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের জন্য আরেকটি স্বস্তি হিসেবে এসেছে। এর আগে গত সপ্তাহে আইএমএফ-এর প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের জন্য ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের তৃতীয় ধাপের ১.১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ে রাজি হয়েছে, যা আগে নির্ধারিত পরিমাণের প্রায় দ্বিগুণ।
বিশ্বব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, 'দেশগুলো দ্রুত অর্থছাড়ের জন্য প্রতিবছর তাদের ইনভেস্টমেন্ট প্রজেক্ট ফাইন্যান্সিং (আইপিএফ) এবং প্রোগ্রাম-ফর-রেজাল্টস (পিফরআর) কার্যক্রমে ছাড়ের অপেক্ষায় থাকা অর্থের ১০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারে।'
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বাড়তি নমনীয়তাসমৃদ্ধ এই নতুন উদ্যোগ চালু হওয়ার ফলে এটি সংকটকালে দ্রুত প্রতিক্রিয়ামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের সক্ষমতা বাড়াবে।
তবে তহবিল পেতে আগে থেকেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরসহ প্রাথমিক কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে বাংলাদেশকে।
পাশাপাশি যেকোনো দুর্যোগ বা সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে বরাদ্দবিহীন একটি নতুন প্রকল্প শুরু করতে হবে এবং ওই প্রকল্পের অর্থ দুর্যোগের সময় কীভাবে ব্যবহার করা হবে তা উল্লেখ থাকতে হবে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাংকে থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জরুরি দ্রুত অর্থায়ন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। দুর্যোগের পর প্রকল্পগুলোর পুনর্গঠনের প্রয়োজন হয় বলে এক্ষেত্রে প্রায়ই বিলম্ব হয়।
'তবে সরকার যদি বিশ্বব্যাংকের নতুন এ পদ্ধতি গ্রহণ করে, তাহলে জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়ার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি থাকবে,' তিনি বলেন।
তিনি আরও বলেন, জরুরি এ তহবিল পেতে হলে দুর্যোগ ঘটতে হবে। হোক সেটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্বাস্থ্যসম্পর্কিত দুর্যোগ অথবা অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব বা দারিদ্র্যের আকস্মিক বৃদ্ধির মতো মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ।
তবে বিশ্বব্যাংক তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দুর্যোগের তীব্রতা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানান তিনি।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের মতামত বিবেচনা করে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার পর বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তহবিলের পরিমাণ, উৎস
আরআরও তহবিলের অর্থ পাইপলাইনে থাকা অর্থের ওপর নির্ভর করবে। যেমন বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০২২–২৩ অর্থবছরের শেষ নাগাদ পাইপলাইনে বাংলাদেশের ৮.৪৭৭ বিলিয়ন ডলার ছিল বলে জানান ইআরডি কর্মকর্তারা।
সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি তহবিলটি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে প্রায় ৮৪৭.৭ মিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে বলে জানান তারা।
তারা আরও বলেন, বিশ্বব্যাংকের চলমান প্রকল্প থেকে বা বাজেট সহায়তায় বরাদ্দ অর্থ নতুন করে বরাদ্দ করার মাধ্যমে এ জরুরি তহবিলের অর্থায়ন করা হবে।
কর্মকর্তারা জানান, যদি আরআরও তহবিল নেওয়া হয়, তাহলে প্রকল্পের কোন অংশ থেকে অর্থ কাটা হবে তা সতর্কতার সঙ্গে ঠিক করা হবে, যাতে বর্তমান প্রতিশ্রুত প্রকল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। যেমন, যেসব প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি, সেখান থেকে তহবিল নেওয়া হতে পারে।
তবে যত প্রকল্প থেকেই অর্থ কাটছাঁট করা হোক না কেন, কোন প্রকল্প থেকে অর্থ কাটা হবে তা উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি আইনি চুক্তি করতে হবে বলেও জানিয়েছেন ইআরডি কর্মকর্তারা।
প্রকল্প কাটছাঁটের আশঙ্কা
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলমান প্রকল্পের তহবিল হ্রাসের ঝুঁকির কারণে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না। বিশ্বব্যাংক আরআরও-এর তহবিলে অর্থ পুনঃবরাদ্দের ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প পদ্ধতির কথা বলেছে: বিদ্যমান প্রকল্পের আয়তন কমানো অথবা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান প্রকল্পে বিকল্প অর্থায়নের সন্ধান করা।
মন্ত্রণালয়গুলো তাদের প্রকল্প থেকে তহবিল পুনঃবরাদ্দে আপত্তি জানাতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন ইআরডি কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, প্রকল্পের তহবিল কাটা হলে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিরোধের সম্ভাবনা রয়েছে।
'যদি সরকার এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে কোনো মন্ত্রণালয় তাদের প্রকল্প কমাতে বা পুনর্গঠন করতে চাইবে না,' বলেন এ অর্থনীতিবিদ।