বাংলাদেশ ব্যাংকের রোডম্যাপের উল্টো পথে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মন্দ ঋণ, এক বছরে বেড়ে ২৭%
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণপ্রাপ্তির শর্ত হিসেবে ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রোডম্যাপ প্রণয়ন করলেও এক বছরের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে ২৭.৪২ শতাংশ হয়ে গেছে।
গত ৭ মে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার এ তথ্য জানিয়েছে। ওই প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২২-এর মার্চের তুলনায় ২০২৪-এর মার্চে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৩.২০ শতাংশ বেড়ে ৮৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৯ সাল থেকে কয়েক দফা ২ শতাংশ পেমেন্টে ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন সুবিধা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া কোভিডকালীন সময়ে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবসায়ীদের 'মোরাটোরিয়াম সুবিধা' দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সম্প্রতি এসব সুবিধা প্রত্যাহার করার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
এছাড়া কৃষি ও এসএমই ঋণ আদায়ের পরিস্থিতি ভালো হলেও বড় গ্রাহকদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে নানা জটিলতা রয়েছে।
সুদহার বাজারভিত্তিক করার কারণে ঋণের সুদহার আরও বাড়বে। ফলে আগামীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের—সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রুপালি, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ও বেসিক—বিতরণ করা ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ ৩ লাখ ১৩ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের মার্চে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। ২০২৩-এর মার্চে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দুই বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের। আর সর্বশেষ এক বছরের মধ্যে বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ কমেছে।
দুই বছরের ব্যবধানে, ২০২২ সালের মার্চ থেকে ২০২৪-এর মার্চ পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৩১ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও ১২১ শতাংশ বেড়েছে।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএম মাহফুজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অনেক আগে বিতরণ করা ঋণ দীর্ঘদিন যাবৎ আদায়ের চেষ্টা করেও আদায় হচ্ছে না। সেসব ঋণ আদায়ের নির্ধারিত মেয়াদ অতিক্রম করায় সেগুলো খেলাপি হয়ে গেছে।'
তিনি বলেন, 'খেলাপি ঋণ কমানো বা খেলাপি ঋণ থেকে আদায়ে আমাদের চেষ্টার অভাব ছিল না। আমরা চেষ্টা করেও যথাযথ সুফল পাচ্ছি না। খেলাপি ঋণ আদায়ের যে প্রক্রিয়া, সেভাবে হাঁটতে হবে। এর বাইরে আমাদের তো কিছু করার নেই।'
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরও বলেন, '২০০৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের বেশ কিছু ঋণে অনিয়ম হয়েছে। সে সময়ে গ্রাহক নির্বাচনে কিছুটা ত্রুটি ছিল, যার কারণে সেসব ঋণ এখন আদায় হচ্ছে না। এসব ঋণ আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।'
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখ্ত টিবিএসকে বলেন, কোভিড ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, 'ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। এরই মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে, ডলারের দাম বেড়েছে। ফলে ব্যবসায়ীদের আয় কমে গেছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
'আগে সুদ মওকুফের আওতায় যেসব ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা হয়েছিল, সেসব ঋণও এখন আবার খেলাপি হয়ে গেছে। ফলে এক বছরের ব্যবধানে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।'
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'যারা ভালো ব্যবসায়ী, আমরা তাদেরকে অল্প অল্প নতুন ঋণ দিয়ে সাহায্য করছি, যাতে ব্যবসা করে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন। তবে যারা অভ্যাসগত খেলাপি বা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তাদের পৃথক তালিকা করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে যাওয়া বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ গত এক বছরে কমেছে। গত বছরের মার্চে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮৭৪ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ। গুটিকয়েক বড় গ্রাহকের কাছে ব্যাংকগুলোর ঋণের বড় অংশ আটকে থাকায় ব্যাংকের ঋণঝূঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ১৮ হাজার ১৭১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। আগের দুই বছরের মার্চে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণও এর প্রায় সমান।
অবলোপন করা এই ঋণকে খেলাপি ঋণের সঙ্গে যুক্ত করা হলে গত মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
খেলাপি ঋণ আদায়
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়লেও খেলাপিদের কাছ থেকে আদায় বাড়ছে না। প্রতি বছর ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ আদায়ের হার ব্যাংকগুলোর এক বছরের লক্ষ্যমাত্রার ৪.৬৭ শতাংশ এবং মোট খেলাপি ঋণের ০.৩৬ শতাংশ।
২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষমাত্রা ৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা; এর বিপরীতে মার্চ শেষে আদায় হয়েছে ৩১৭ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ আদায়ে সবচেয়ে বড় লক্ষ্যমাত্রা জনতা ব্যাংকের। এ বছর খেলাপি থেকে ব্যাংকটির আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিপরীতে মার্চ শেষে আদায় হয়েছে মাত্র ৪১ কোটি টাকা।
চলতি বছর ১ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মার্চ শেষে অগ্রণী ব্যাংক আদায় করেছে ৬৮ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংকের খেলাপি থেকে ১ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে রূপালী ব্যাংকের ৮০০ কোটি, বিডিবিএলের ২০০ কোটি ও বেসিক ব্যাংকের ৭৫০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। মার্চ শেষে রূপালী ব্যাংকের আদায় ৬৭ কোটি, বিডিবিএলের ১৮ কোটি ও বেসিক ব্যাংকের ৪০ কোটি টাকা।
আদায় নেই শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে
শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে পাওনার পরিমাণ ৩০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা; বিপরীতে এ বছর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। কিন্তু বছরের প্রথম ত্রৈমাসিক শেষে আদায়ের পরিমাণ মাত্র ৮.৭ কোটি টাকা।
শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ৫ হাজার ৮১ কোটি টাকা। এ বছর ব্যাংকটি খেলাপিদের কাছ থেকে ৩০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও মার্চ শেষে আদায় হয়েছে মাত্র ০.২০ কোটি টাকা।
একইভাবে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে সোনালী ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯১০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মার্চ শেষে ব্যাংকটি আদায় করেছে ০.৪৫ কোটি টাকা।
শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে অগ্রণী ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ৮ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। এ বছর ৬৮৫ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ব্যাংকটি আদায় করেছে ২ কোটি টাকা।
অবলোপনকৃত ঋণ
অবলোপন করা ঋণ থেকেও আদায় করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সোনালী ব্যাংকের অবলোপন করা ঋণ থেকে ৫০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মার্চ শেষে আদায় হয়েছে মাত্র ৪ কোটি টাকা।
এ বছরের ডিসেম্বর শেষে জনতা ব্যাংকের অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩২৪ কোটি টাকা। মার্চ শেষে ব্যাংকটির আদায় হয়েছে ১৬ কোটি টাকা।
একইভাবে অগ্রণী ব্যাংক পুরো বছরে অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ৪০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় করেছে ১৪ কোটি এবং রূপালী ব্যাংক ৬০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মার্চ শেষে ৩২ কোটি টাকা আদায় করেছে।