পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে কমিশন দেওয়ার প্রস্তাব
বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্স – অর্থ ফেরত আনতে সহায়তাকারী সরকারি কর্মকর্তাদের ফেরত আনা তহবিলের একটি অংশ কমিশন হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে।
একজন অ্যাটর্নি জেনারেলকে আহ্বায়ক করে গঠিত এই টাস্কফোর্স – গত ১৭ এপ্রিল এক সভায় বিষয়টি পর্যালোচনা করে একটি সংশোধিত খসড়া আইন প্রণয়ন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠাতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-কে নির্দেশনা দিয়েছে।
আয়কর এবং শুল্ক আইনে বর্ণিত বিধান অনুসারে কমিশন দেওয়া হবে। এজন্য টাস্কফোর্স বিএফআইইউকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-তে প্রাসঙ্গিক ধারাগুলি অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছে।
পাচার হওয়া অর্থ শনাক্তকরণ, তদন্ত করা এবং মামলা পরিচালনার মাধ্যমে ফেরত আনার প্রক্রিয়ায় সাধারণত দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও পুলিশের সিআইডি'র কর্মকর্তারা সম্পৃক্ত থাকেন। ফলে পাচার হওয়া অর্থসম্পদ উদ্ধার হলে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কমিশন পাবেন। তবে কমিশনের হার কতো হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় প্রচেষ্টা
পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরানোর সাম্প্রতিক উদ্যোগটি হচ্ছে এবিষয়ে দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে পাচার করা সম্পদ দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়ার নীতি নেয়।
ওই নীতির আওতায়, অঘোষিত সম্পদধারীদের বিদেশে থাকা তাদের স্থাবর সম্পদ সৎ করদাতাদের চেয়েও কম হারে কর দিয়ে ট্যাক্স রিটার্নে ঘোষণা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অথচ ওই অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হারে কার হার রাখা হয়েছিল সৎ করদাতাদের জন্য।
রাজস্ব কর্তৃপক্ষের সূত্রগুলো বলছে, এমন সহজ শর্ত দেওয়ার পরেও কোনো তহবিলই ফেরত আনতে পারেনি এই নীতি। অর্থাৎ, একটি টাকাও এভাবে ফেরত আসেনি।
অর্থ উদ্ধারে কমিশন দেওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন গত বৃহস্পতিবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এজন্য আইন সংশোধন করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। "আমরা পাচার হওয়া সম্পদ শনাক্তকরণ ও উদ্ধারে করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
অর্থ উদ্ধারে নেটওয়ার্ক
টাস্কফোর্সের সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা পাওয়ার জন্য ১০টি দেশের সঙ্গে চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতোমধ্যে চুক্তির খসড়া কপি দেশগুলোতে পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড এবং হংকং-চীন। এসব দেশেই বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার করে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের কাছ থেকে চুক্তির খসড়া কপি পাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়া আরও কিছু তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে। এছাড়া, হংকং কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের কাছে তিনটি খসড়া চুক্তির কপি পাঠিয়েছে, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ পর্যালোচনা করছে।
যেসব দেশে চুক্তির খসড়া পাঠানো হয়েছে, সেসব দেশের বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে ফলোআপ করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন টাস্কফোর্স প্রধান ও অ্যাটর্নি জেনারেল।
পাচার হওয়ার অর্থ উদ্ধারে ১০টি দেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, বিএফআইইউ টাস্কফোর্সের সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে। এসংক্রান্ত তথ্য তাদের কাছে থাকতে পারে।
টাস্কফোর্সের সভায় দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন প্রতিনিধি জানান যে, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে পারস্পরিক সহায়তার জন্য সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন গ্লোব নেটওয়ার্ক নামে একটি আন্তর্জাতিক ফোরামের সদস্য হয়েছে।
এছাড়া, জননিরাপত্তা বিভাগকে অ্যাসেট রিকভারি ইন্টারএজেন্সি নেটওয়ার্ক এশিয়া প্যাসিফিক (এআরআইএন- এপি)-র সদস্য হতে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গ্লোব নেটওয়ার্ক অ্যান্ড গ্লোবাল ফোরাম অন ট্রান্সপারেন্সি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ইনফরমেশন ফর ট্যাক্স পারপাস- এর সদস্যপদ নেওয়া উচিত বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে টাস্কফোর্স।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর থাইল্যান্ড সফরকালে দেশটির সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান– ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, দুবাই শহরে শতভাগ প্রস্তুত আবাসন সম্পদ কিনেছেন বা কিনতে মনস্থ করছেন, এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ২০২২ সালে ছিল ৩৯৪ জন। তাঁরা মোট ২২ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের সম্পদ কিনেছেন। এই বাংলাদেশিরা মোট ৬৪১টি সম্পদ কিনেছিলেন।
পাচার হওয়া অর্থ-সম্পদ উদ্ধারের চ্যালেঞ্জ
টাস্কফোর্সের সভায় কস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিনিধি জানান, বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় যে, আমদানির ঘোষণায় যে পণ্য দেশে আসার কথা, তা না এনে প্রকৃতপক্ষে অন্য পণ্য আনা হয়েছে। এসব ঘটনায় বিদেশি রপ্তানিকারকের তথ্যের সঠিকতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে তারা অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন।
"এক্ষেত্রে রপ্তানিকারকের তথ্যের সঠিকতা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস তথ্য সরবরাহ করলে তা তদন্তে সহায়ক হবে" বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গত বছরের ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট বলেছে, আমদানি-রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতামুলক দামের কোন তথ্যভান্ডার না থাকায় – বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থপাচার প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব।
বিএফআইইউ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিতদের সঙ্গে যোগসাজশে বা জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করে বিদেশে অর্থপাচারের অপরাধে অভিযুক্তরা অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং এসব ঘটনা তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে।
ওভার-ইনভয়েস ও আন্ডার-ইনভয়েসের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়। এতে আরো বলা হয়, রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন কর না থাকা এবং কিছু পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শূন্য শুল্কহার থাকায় কাস্টমস কর্মকর্তারা রপ্তানি চালান যাচাইয়ে কম মনোযোগী হন। পাচারকারীরা এই সুবিধাটিই বেশি গ্রহণ করছে।
অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী বিদেশে সন্তানের লেখাপড়ার আড়ালে অর্থপাচার করে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি কিনছেন বলেও উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।
বিএফআইইউ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এসব ঘটনা তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মামলার বিষয়বস্তুর সম্পর্কে অনেক সময়েই অভিজ্ঞ থাকেন না।
অর্থ ফেরত আনার সাফল্য যৎসামান্য
ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। কিন্তু পাচার হওযা অর্থ উদ্ধারে সরকারের তেমন কোন সফলতা নেই।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গত অর্থবছরের বাজেটে ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার সুযোগ দিয়েছিলো সরকার। কিন্তু পুরো বছরজুড়ে একজন পাচারকারীও অর্থ ফেরত আনেনি।
সে তুলনায়, যুক্তরাষ্ট্রের ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত অফশোর ভলানটারি ডিসক্লোজার প্রোগ্রামের আওতায় ৪৫ হাজার করদাতার কাছ থেকে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার কর, জরিমানা ও সুদ আদায় করেছে বলে উল্লেখ করেছে বিএফআইইউ।
সুইস ব্যাংকে গোপন হিসাব রয়েছে এমন করদাতাদের কাছ থেকে ফ্রান্স ১২০ কোটি ইউরো ও ইতালি ৫৭ কোটি ইউরো ফাঁকি দেওয়া কর ও জরিমানা আদায় করেছে। একই তথ্যের ভিত্তিতে, যুক্তরাজ্য ১৫ কোটি পাউন্ড ও স্পেন ২১ কোটি ইউরো আদায় করেছে।
সুইস ও লিখটেনস্টেইন ব্যাংকের গোপন হিসাবের তথ্য অন্য এক হুইসেলব্লোয়ারের কাছ থেকে নিয়ে জার্মানি ২০১০ সালে ১৬০ কোটি ইউরো কর পুনরুদ্ধার করেছে।