দুই পক্ষের কাছে শেয়ার বিক্রি মূল মালিকদের, বেঙ্গল ফাইনের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব
মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে বেঙ্গল ফাইন সিরামিক্স লিমিটেডের কারখানা দখলের অভিযোগ উঠেছে ২০০৯ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূল বোর্ড থেকে বাদ পড়া সি পার্ল বিচ রিসোর্টস অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে।
অধিগ্রহণ করা কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতারা স্পন্সর-পরিচালকদের শেয়ার দুটি ভিন্ন পক্ষের কাছে—ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ কে রায় ও সি পার্লের মালিকপক্ষ—বিক্রি করার পর এ বিরোধের সৃষ্টি হয়।
বিশ্বজিৎ ২০১২ ও ২০১৩ সালে কোম্পানিটির মূল স্পন্সর ও পরিচালকদের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের মাধ্যমে ২৪.২৯ শতাংশ শেয়ার কিনে নেন।
কোম্পানিটির মূল উদ্যোক্তা এনামুল ওয়াদুদ খান ও তার পরিবার। এনামুল ওয়াদুদের ভাই রাশেদ মাকসুদ খান ও তার মেয়ে ফারজানা রুবাইয়াত খান কোম্পানির পরিচালক ছিলেন। তারা যৌথভাবে ৩০.১৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক।
নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে ২০০৭ সাল থেকে বন্ধ থাকা কোম্পানিটিকে ২০১৯ সালে উৎপাদনে ফিরিয়ে আনেন বিশ্বজিৎ। বর্তমানে বেঙ্গল ফাইন সিরামিক্সের বার্ষিক আয় প্রায় ২০ কোটি টাকা।
বিশ্বজিৎ-এর ছেলে এবং বেঙ্গল ফাইন সিরামিক্সের নির্বাহী পরিচালক অভিজিৎ কুমার রায় সাংবাদিকদের বলেন, রোববার (২৬ মে) ঢাকার সাভারে অবস্থিত কোম্পানিটির কারখানা জোরপূর্বক দখল করে নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, 'রোববার সকাল ৯টার দিকে সি পার্ল গ্রুপের লোকজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী নিয়ে জোরপূর্বক আমাদের কারখানায় প্রবেশ করে। এ সময় হামলাকারীরা কারখানা থেকে আমাদের নিরাপত্তা কর্মী, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বের করে দিয়ে কারখানা ও অফিস ভবনের দখল নেয়।'
কারখানা দখলের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিকও মারধরের শিকার হয়েছেন।
কারখানায় গেইটে উপস্থিত সি পার্ল গ্রুপের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মশিউর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'অবৈধভাবে কারখানা দখলের কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং যারা ছিলেন (বিশ্বজিৎ), তারাই অবৈধভাবে ছিলেন। আমরা সকালে শান্তিপূর্ণভাবে কারখানায় প্রবেশ করেছি।'
এ সময় কারখানা পরিদর্শনের পর সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহজামান টিবিএসকে বলেন, 'ঘটনাস্থলে এসে কোনো বিশৃঙ্খলা পাইনি। মূল মালিক যে কারা, তা আমরা এখনও জানি না।'
অভিজিৎ জানান, কারখানায় প্রবেশ করতে না পেরে তিনি ৯৯৯-এ কল করার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।
যেভাবে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত
এমওইউ অনুসারে, ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ কে রায় প্রতিটি শেয়ার ৭৫ টাকা দামে কিনেছেন। ১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। তবে বিশ্বজিৎ টিবিএসকে বলেন, বিভিন্ন জটিলতার কারণে এবং মূল মালিকদের নির্লিপ্ততার কারণে এখনও তার বেনিফিশিয়ারি ওনার (বিও) অ্যাকাউন্টে শেয়ারগুলো হস্তান্তর করা হয়নি।
বেঙ্গল ফাইন সিরামিক্সের প্রতিষ্ঠাতারা তাদের শেয়ার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সি পার্ল বিচের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল হক, তার ভাই ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র একরামুল হক ও তার ছেলে শিমুল হকের কাছেও বিক্রি করেন।
আর সেই সূত্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত বছরের ডিসেম্বরে আমিনুল ও তার পরিবারের সদস্যদের কাছে শেয়ার হস্তান্তরের অনুমতিও দিয়েছে।
আর বিএসইসির অনুমতি থাকায় কোম্পানিটির দখল নিয়েছেন সি পার্লের মালিকেরা।
অভিজিৎ টিবিএসকে বলেন, 'এমওইউ সম্পাদনের পর কোম্পানির মূল মালিকরা বিএসইসির কাছে লিখিত আবেদন করলেও কমিশনের অনুমতি পাওয়ার আগেই কোম্পানির মূল মালিকরা টাকা নিয়েছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'শেয়ার বিক্রির টাকা বুঝে নিলেও মূল মালিকদের একজন রাশেদ মাকসুদ খান ডিউ ডিলিজেন্সের কথা বলে শেয়ার ট্রান্সফার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আর সেই শেয়ার বুঝে পাইনি আমরা। সে কারণে বার্ষিক সাধারণ সভার মাধ্যমে কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছি, যাতে কোম্পানির উৎপাদন চলছে।'
শেয়ার বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির মূল উদ্যোক্তা ও সাবেক শেয়ারহোল্ডার পরিচালক এনামুল ওয়াদুদ খান কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
একই শেয়ার দুইবার বিক্রি করেছেন—এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'মালিক ছিলাম, শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছি। এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।' যারা শেয়ার কিনেছে, তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, মূল মালিকদের কাছ থেকে বিশ্বজিৎ শেয়ার কিনলেও ওই শেয়ারের মালিকানা পরিবর্তন হয়নি। ফলে মূল উদ্যোক্তাদের একজন নতুন উদ্যোক্তার (সি পার্ল) কাছে শেয়ার বিক্রির আবেদন জানালে কমিশন অনুমতি দিয়েছে।
প্রথম ক্রয়
৪৬ কোটি টাকার দায়-দেনাসহ কোম্পানিটির মোট ১ লাখ ৫৭ হাজার ৯০৪টি শেয়ার কিনেছিলেন বিশ্বজিৎ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে বিশ্বজিতের শেয়ার কেনার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
১৫০ টাকার স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরিত এমওইউ অনুযায়ী, শেয়ার কেনার বিপরীতে বিশ্বজিৎ কোম্পানি ও কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মোট ৪৬ কোটি টাকার দায় পরিশোধ করবেন। বিনিময়ে কোম্পানি ও সম্পদের মালিকানা পাবেন।
এমওইউ অনুসারে, অগ্রণী ব্যাংকে কোম্পানিটির ৩০ কোটি টাকার ঋণ, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের প্রায় ৪ কোটি টাকার ঋণ, ২ কোটি টাকা ইউটিলি বিল, ৫.৭১ কোটি টাকার অন্যান্য দায় এবং আইসিবি ডিবেঞ্চারের ৪.১৬ কোটি টাকা পরিশোধ করবেন বিশ্বজিৎ।
অগ্রণী ব্যাংকের কাছে কোম্পানির ঋণের ৩০ কোটি টাকার মধ্যে ৮.৪০ কোটি টাকা পরিশোধ করে ব্যাংকঋণ নিয়মিত করার পাশাপাশি কোম্পানির বকেয়া ইউটিলিটি বিলসহ কোম্পানির বিভিন্ন দায়ও পরিশোধ করেছেন বিশ্বজিৎ।
সব সম্পদ বুঝে না পাওয়ায় দেনা পরিশোধে আপত্তি
সূত্রমতে, দায়-দেনা পরিশোধ করে কোম্পানির জমি, সম্পদ পাবেন—এমন শর্তে শেয়ার কিনলেও জমির সবটুকু বুঝে পাননি বিশ্বজিৎ।
এ কারণে তিনি কোম্পানিটির নামে নেওয়া ঋণ নিয়মিত করলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ঋণ পরিশোধ কিংবা দায় পরিশোধ করেনি। এ কারণে চুক্তি বাতিল করতে আদালতে যান আগের মালিকরা।
তবে ২০১৬ সালে মূল মালিকরা কোম্পানির মালিকানা দাবি করে মামলা দায়ের করলেও উচ্চ আদালতের রায়ে বিশ্বজিৎ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পান।
২০২৪ সালে রাশেদ মাকসুদ খান মারা গেলে তার মেয়ে ফারহানা রুবায়েত খান মালিকানা দাবি করেন এবং তিনি তার পিতার বিক্রি করা শেয়ার সি পার্লের মালিকদের কাছে বিক্রি করেন।
কোম্পানির মালিকানা ক্রয়, চালু ও দখলের বিষয় তুলে ধরে গত মাসে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে চিঠিও দিয়েছেন অভিজিৎ। ওই চিঠিতে জোরপূর্বক উচ্ছেদের অভিযোগ তোলেন তিনি।
তদন্ত চলাকালেই শেয়ার বিক্রির অনুমতি দিল কমিশন
বিএসইসির অনুমতি না নিয়ে শেয়ার বিক্রি করায় ২০২২ সালের ২৭ জুলাই বেঙ্গল ফাইন সিরামিক্সের বিষয়ে যাবতীয় বিষয় তদন্তে তথ্য দিতে অভিজিৎকে চিঠি দেয় কমিশন। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়।
অভিজিৎ কে রায় বলেন, শেয়ার বিক্রিসহ কোম্পানির যাবতীয় বিষয়ে তদন্ত চলমান থাকা অবস্থাতেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি অন্য আরেকটি পক্ষের কাছে মূল স্পন্সর-পরিচালকদের ২৩.২৭ শতাংশ শেয়ার হস্তান্তরের অনুমোদন দিয়েছে।