বিসিসিআই-এর পতন থেকে যেভাবে শীর্ষ ব্যাংকে পরিণত হলো ইবিএল
ব্যাপক অনিয়ম-জালিয়াতি ও অর্থপাচারে জড়িতে হয়ে পড়ায় ১৯৯১ সালের ৫ জুলাই বৈশ্বিকভাবে ধসে পড়ে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল কমার্স (বিসিসিআই)। এসময় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডসহ বেশকিছু দেশের আর্থিকখাত নিয়ন্ত্রক বিসিসিআইয়ের সম্পদ জব্দ করে এবং এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এ ঘটনায় সঙ্গতকারণেই ব্যাংকটির বাংলাদেশের আমানতকারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন।
আমানতকারীদের এই উদ্বেগের কথা মাথায় রেখে, তাঁদের স্বার্থরক্ষা এবং আরো আর্থিক অস্থিতিশীলতা রোধে দেশে বিসিসিআইয়ের সম্পদ জব্দ করার দ্রুত পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
ইবিএলের দর্শন হলো 'কোয়ালিটি ওভার কোয়ান্টিটি'। গুণগত মান নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ বেশি। আপনি যদি পণ্য ও সেবার মান নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে ব্যবসা তো আপনা-আপনিই আসবে।"
বিসিসিআই পতনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা এবং গ্রাহকদের জন্য একটি সমাধান দিতে একটি পুনর্গঠন পরিকল্পনা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। যা ১৯৯২ সালের আগস্টে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) গঠনে সহায়তা করে। মূলত বিসিসিআইয়ের স্থানীয় সম্পদ ও দায় নিয়ে গঠন করা হয় ইবিএল।
মোট ৩১৪ কোটি টাকার ক্ষতি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ইবিএল; তাই ব্যাংকটি লাভজনকে পরিণত হওয়ার আগে কোনো লভ্যাংশ বা ফি নেননি এর পরিচালকরা। লাভজনকে পরিণত হতে সময় লেগেছিল ছয় বছর। বর্তমানে ব্যাংকটির পারফরম্যান্স সূচকগুলো বেশিরভাগ ব্যাংককে ছাড়িয়ে গেছে, এরমধ্যে কিছু ব্যাংক আছে যারা ইবিএলের চেয়েও পুরোনো।
বর্তমানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংক হিসেবে গণ্য করা হয় ইবিএলকে। আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী সংস্থা- মুডিসের প্রথম রেটিং পাওয়া বাংলাদেশি ব্যাংক হলো ইবিএল। লন্ডন-ভিত্তিক দ্য ব্যাংকার থেকে তিনবার বাংলাদেশের সেরা ব্যাংক হিসেবে সম্মানজনক স্বীকৃতি পেয়েছে।
ইবিএল কর্পোরেট বা বাণিজ্যিক ঋণ প্রদানেই বেশি সম্পৃক্ত, ২০২৩ সাল পর্যন্ত তাদের মোট ঋণের ৭৮ শতাংশই ছিল কর্পোরেট ঋণ। এরপরেও নন-পারফর্মিং বা খেয়াপি ঋণের অনুপাত ৩.১ শতাংশে রাখতে পেরেছে, যা দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন।
২০২৩ সালের শেষে শেয়ারে ১৬.৩৩ রিটার্ন দিয়েছে ইবিএল, খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির হার ছিল প্রায় ১৫০ শতাংশের মতো উচ্চ। গেল বছরে যখন দেশের অনেক ব্যাংকেরই আমানত কমেছে, সেখানে এই প্রবণতায় না দমে ১৫.৪৫ শতাংশ আমানত বাড়াতে সক্ষম হয় ইবিএল। ঋণ ও অগ্রিম প্রদান বাড়ে ১৪.৩৯ শতাংশ, আর করপ্রদান পরবর্তী মুনাফা ২০ শতাংশ বেড়ে ৬১১ কোটি টাকা হয়েছে।
ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন অনুপাত ১২.৫ শতাংশ রাখার নিয়ম থাকলেও, ইবিএলের রয়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। দেশের অন্যতম শীর্ষ লভ্যাংশ (ডিভিডেন্ট) প্রদানকারী ব্যাংক এখন ইবিএল; গত তিন বছর ধরে ২৫ শতাংশ ডিভিডেন্ট দিয়েছে।
ব্যাংকটির আয়-ব্যয়ের অনুপাত ৪৪.২২ শতাংশ। অর্থাৎ, ১০০ টাকা আয় করতে তাঁদের খরচ হচ্ছে ৪৪ টাকার কিছু বেশি। সে তুলনায়, দেশের ব্যাংকখাতের গড় আয়-ব্যয় অনুপাত ৫০ শতাংশের বেশি।
তবে ১৯৯০ এর দশকে তাকালে আমরা দেখি ভিন্ন চিত্র। ১৯৯৯ সালে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৮.৭৭ শতাংশ; মোট মুনাফা ছিল ৪১ কোটি টাকারও কম। ২০০১ সয়ালে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় মোট ঋণের ১১.৫২ শতাংশে, আর ২০০৩ সালে পৌঁছায় ১৩.৬১ শতাংশে। ১৯৯৫ সালে ব্যাংকের পরিচালন আয় হয় ৪৩ কোটি টাকারও কম, যা ২০২৩ সালে ব্যাপকভাবে বেড়ে পৌঁছায় ২ হাজার ৫৩ কোটি টাকায়।
যেভাবে সম্ভব হয়েছে এই রূপান্তর
১৯৯১ সয়ালে বিসিসিআইয়ের ধসের পর ব্যাংকের একজন বড় আমানতকারী মীর নাসির হোসেন গভীর উদ্বেগ ও হতাশায় পড়েন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন ব্যাংকটি পুনর্গঠনের কর্মসূচি নেয়, তখন কিছুটা নির্ভার হয়েছিলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মসূচিতে আমানতকারীদের দুটি উপায়ের যেকোনো একটি নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়: হয় তাঁদের আমানতের সমমূল্যের শেয়ারহোল্ডার হওয়া, নয়তো পাঁচ বছর ধরে হ্রাসকৃত হারে আমানত ফেরত নেওয়া। মীর নাসির উদ্দিন শেয়ারহোল্ডার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, এবং তার ফলস্বরূপ এম গাজিউল হক, মো. শওকত আলী চৌধুরী - ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান এ এম শওকত আলী এবং মোহাম্মদ নূর আলীর সাথে ইবিএল-এর পরিচালক হন।
মীর নাসির উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রথম দিন থেকেই, আমরা ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড় করানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করি। শুরুতেই করা হয় দায়ের একটি মূল্যায়ন। আমাদের পরিকল্পনাটি ছিল সময়-নির্দিষ্ট। এসব প্রচেষ্টার ফলে পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যেই ব্রেকইভেন পজিশনে (মোট খরচ ও আয়ে সমান সমান) চলে আসে ইবিএল।"
২০০২ সয়ালে ব্যাংকটিতে আইটি বা তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার চালু করা ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। "ফলে অ্যাকাউন্ট যেখানেই থাকুক না কেন, যেকোনো শাখা থেকেই ব্যাংকিং করার সুবিধা পান গ্রাহকরা।"
যেসব কারণে বিসিসিআইয়ের পতন হয়েছিল, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি হওয়া ঠেকাতে – দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্নদের নিয়োগ দিয়ে নতুন একটি ব্যবস্থাপক টিম গঠন করা হয়। এজন্য বহুজাতিক ব্যাংকে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সুদক্ষদেরই নিয়োগ করে ইবিএল। বলছিলেন, ইবিএলের সাবেক চেয়ারম্যান মীর নাসির, যিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়েরও সাবেক সভাপতি।
তিনি বলেন, "আমরা তাঁদের কাজ করার স্বাধীনতা দেই, পারফরম্যান্স ভালো হলে পুরস্কৃতও করেছি। আমরা (পরিচালকরা) নীতি প্রণয়ন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছি, কিন্তু কখনোই ব্যাংকের ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তে কখনো হস্তক্ষেপ করিনি।" টানা পাঁচ বছর বোর্ডের পরিচালকরা কোনোপ্রকার ফি নেননি বলেও জানান তিনি।
"২০০২ সালে কে মাহমুদ সাত্তারকে ইবিএলের সিইও হিসেবে পাওয়া ছিল আরেকটি টার্নিং পয়েন্ট" - তিনি বলছিলেন, ওই সময়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ— এদেশে এএনজেড গ্রিন্ডলেসের ব্যবসা অধিগ্রহণের করার পরে সাত্তার সেখানে যোগ দিয়েছিলেন।
পেশাদারত্ব ও নিরপেক্ষতা
মীর নাসির হোসেন বলেন, "ইবিএল এখন এতটাই পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে– যে বোর্ডের পরিচালকরা স্বার্থের দ্বন্দ্ব এড়াতে নিজেদের ব্যাংকেই ব্যাংকিং করে না। কোনো ব্যাংকের পরিচালকরা যদি সততা, নিষ্ঠা এবং বাস্তবসম্মতভাবে কাজ করেন, তাহলে ব্যাংকটি অবশ্যই একটি ভালো ব্যাংক হয়ে যাবে।"
ইবিএলে যোগ দেওয়ার পর সে সময়টা কতো কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং ছিল আজো তা স্মরণে আছে মাহমুদ সাত্তারের। তবু ব্যাংকের আমূল রুপান্তরের চ্যালেঞ্জই কাঁধে নেন, এবং তাতে সফলও হন।
কীভাবে পেলেন এই সফলতা? এমন প্রশ্নে সাত্তার বলেন, "কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার এবং যেকোনো শাখা থেকে লেনদেন চালু করা বাংলাদেশের প্রথম ব্যাংক ছিল ইবিএল। পরের ধাপটা ছিল কর্পোরেট, রিটেইল ও এসএমই সেগমেন্টে ব্যবসার বিভাজন।"
পরে ইবিএল ঋণ ও আইটির জন্য কিছু নিয়ম চালু করে এবং ব্যাংকিং প্রক্রিয়ার আরো কেন্দ্রীয়করণ করে। "তারপর থেকে ব্যাংককে আর পিছু ফিরে দেখতে হয়নি। "বর্তমানে এটি দেশের অন্যতম একটি টেক-স্যাভি (প্রযুক্তিদক্ষ) ব্যাংক" - টিবিএসকে বলেন তিনি।
ইবিএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার। তিনি ২০০৪ সালে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। এরপর ২০০৭ সালে এমডি হিসেবে পদোন্নতি পান, তখন থেকেই ব্যাংকের এই রূপান্তরে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ইফতেখার টিবিএসকে বলেন, "আমরা যখন পুনর্গঠনের মধ্যে ছিলাম, তখন আমরা ব্যবসার প্রবৃদ্ধি ও ব্রান্ডিংয়ের দিকে মনোযোগ দেই। আমাদের এই পরিকল্পনা সফল হয়।"
গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ইবিএলের খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশের ঘরে রয়েছে। ইবিএল কর্পোরেট ব্যাংকিং-নির্ভর হওয়ার পরেও এত কম খেলাপি অনেককেই বিস্মিত করে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ইবিএল পারলে, অন্যরা কেন পারছে না
১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত ইবিএলের শাখা রয়েছে মাত্র ৮৫টি। ২০১৩ সালের চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোসহ অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় যার সংখ্যা অনেকটাই কম। তবুও বেশি শাখা থাকা ব্যাংকের চেয়ে ইবিএল ধারাবাহিকভাবে উচ্চ মুনাফা করছে।
এই অর্জন এলো কীভাবে? -জানতে চাইলে ইবিএলের এমডি বললেন, ব্যাংকের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির পেছনে অবদান রেখেছে গ্রাহকের আস্থা অর্জন এবং নিয়মানুবর্তিতা।
ইফতেখার বলেন, ইবিএল এখন একটি ট্রিপল- এ রেটেড কোম্পানি, আমাদের দর্শন হলো 'কোয়ালিটি ওভার কোয়ান্টিটি'। অর্থাৎ পরিমাণের চেয়ে গুণগত মান নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ বেশি। বাংলাদেশের কোনো বেসরকারি ব্যাংকে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে এমডি পদে থাকা ইফতেখারের মতে, "আপনি যদি আপনার পণ্য ও সেবার মান নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে ব্যবসা তো আপনা-আপনিই আসবে।"
তিনি বলেন, গ্রাহকদের ব্যাংকের শাখায় এনে সেবা দেওয়ার চেয়ে– ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাঁদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করাকে মূল উদ্দেশ্য হিসেবে রাখা হয়েছে। এরই প্রতিফলন দেখা যায় আমাদের মাত্র ৮৫টি শাখার সংখ্যায়, যা সব প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এরফলে নতুন শাখা প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনার খরচও কম ইবিএলের।
"আমাদের গ্রাহকসম্পর্ক ব্যবস্থাপক ও বিক্রয়কর্মীর একটি বড় টিম আছে, যারা সেবা দিতে সরাসরি গ্রাহকের দ্বারপ্রান্তে যায়।" ব্যাংকের নিম্ন খেলাপি ঋণ সম্পর্কে জানান, তাঁদের ঋণ আদায়কারী টিমটিও যথেষ্ট শক্তিশালী, প্রতিবছরই যেখানে নতুন করে ২৫ থেকে ৩০ জনকে নিয়োগ করা হচ্ছে।
ইবিএলের এমডির মতে, ব্যাংকের কর্পোরেট সুশাসন নিয়ে উৎকণ্ঠা, আশঙ্কার কারণে গত বছর অনেক লো-পারফর্মিং ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা অনেকটাই হ্রাস পায়, কিন্তু একইসময়ে সঠিকভাবে নিয়মনীতি অনুসরণ করে চলার ট্র্যাক রেকর্ড থাকায়– গ্রাহকদের পছন্দের ব্যাংক হিসেবে আরো বিকাশ হয়েছে ইবিএলের।
তিনি জানান, ২০০৭ সাল থেকে ইবিএল কোনো বিধান/ নীতিমালা ভঙ্গ করেনি। ২০১৩ সালে আইসিএসবি ন্যাশনাল আওয়ার্ড ফর কর্পোরেট গভর্নেন্স এক্সিলেন্স চালু হওয়ার পর থেকে ইবিএল পাঁচটি গোল্ড অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। এটি ইবিএলে কর্পোরেট সুশাসনের বলিষ্ঠ সংস্কৃতিরই প্রমাণ।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "আমাদের ঋণ নীতি যথেষ্ট কঠোর; যেটা আমরা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করি। যেমন ঋণ প্রদান ও গ্রাহক নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথাযথ কাগজপত্র, সই-সাবুদ মেনে চলা হয়। তাঁর সাথে আমাদের শক্তিশালী ঋণ সংগ্রহ (আদায়) ও তদারকির কার্যক্রম ২০২৩ সালটা রেকর্ড নিট মুনাফা নিয়ে শেষ করতে সাহায্য করেছে।"