২০২৩ অর্থবছরে সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য কমেছে
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য, অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানি উভয়ই কমছে।
রোববার (২ জুন) কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলো থেকে ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ১.৯১ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছর ২০২২- এ ছিল ১.৯৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, আলোচ্য সময়ে সার্কভুক্ত দেশগুলো থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রায় ১ শতাংশ কমেছে।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে— আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ যে পরিমাণ রপ্তানি করেছে তার ৩.৪৪ শতাংশ হয়েছে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে। রপ্তানির বড় অংশই পাঠানো গিয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে।
২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের সামগ্রিক রপ্তানি ৫৫.৫৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬.২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে। তবে এই প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, সার্কভুক্ত দেশগুলোতে রপ্তানি কম হয়েছে। আমদানির দিক থেকেও সার্কের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ভালো হয়নি; এসব দেশে বাংলাদেশের মোট আমদানি মূল্য পরিশোধের মাত্র ১৫ শতাংশ গিয়েছে।
২০২২ অর্থবছরে সার্কভুক্ত দেশগুলো থেকে মোট আমদানি হয়েছিল ১৪.৯৩ বিলিয়ন ডলারের; ২০২৩ অর্থবছরে এটি নেমে এসেছে ১০.৪৩ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ, আমদানি কমেছে প্রায় ৩১ শতাংশ।
ডলার ঘাটতি মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে দেশের সামগ্রিক আমদানি ১৫.৭৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এতে অন্যান্য দেশের তুলনায় সার্কভুক্ত দেশগুলো থেকেই আমদানি সবচেয়ে দ্রুত গতিতে কমেছে।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য কেন কমছে– জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, "ডলার সংকটের কারণে এমনিতেই আমদানি কিছুটা কমেছে। তবে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের কম্প্যারেটিভ অ্যান্ড কমপিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ (তুলনামূলক এবং প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা) কম। অর্থাৎ, দেশগুলো একইরকম বা কাছাকাছি ধরনের পণ্য উৎপাদন করে। ফলে, সেখানে আমদানি বা রপ্তানির সুযোগ কমে যায়।"
"বাংলাদেশ থেকে এই দেশগুলোতে রপ্তানির ক্ষেত্রেও খুব বেশি স্পেশালাইজড প্রোডাক্ট নেই, যেটা শুধুমাত্র আমাদের দেশেই পাওয়া যায়। ফলে দেশগুলোতে আমাদের অনেক পণ্যের চাহিদাও কম," বলেন তিনি।
আমদানি বা রপ্তানিতে ট্যারিফ বা শুল্কের বাইরেও ব্যবসা পরিচালনার খরচ, বন্দর, ল্যাব সুবিধাসহ অনেক উপাদান আছে– যেগুলো বাণিজ্য বাড়তে দেয় না বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
নেপালে রপ্তানি কম, বেড়েছে ভারত-শ্রীলঙ্কায়
সার্কভুক্ত দেশগুলোতে রপ্তানির ক্ষেত্রে মিশ্র প্রবণতা দেখা গেছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান এবং ভুটান থেকে রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়লেও কমেছে নেপাল ও পাকিস্তান থেকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ অর্থবছরে ভারত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১.৭১ বিলিয়ন ডলার– যা গত ২০২২ অর্থবছরের ১.৬৮ বিলিয়ন ডলার থেকে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে আয় বেড়েছে ১.৮৫ শতাংশ।
অন্যদিকে, পাকিস্তান থেকে রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০২২ অর্থবছরে দেশটি থেকে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৮৯ মিলিয়ন ডলার– যা ২০২৩ অর্থবছরে ৮৩ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, উল্লিখিত সময়ে পাকিস্তানে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেছে ৭.০৭ শতাংশ।
এছাড়া, নেপাল থেকে রপ্তানি আয় নাটকীয়ভাবে ৯৭ মিলিয়ন ডলার থেকে ৪১ মিলিয়ন ডলারে হ্রাস পেয়েছে। ২০২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩ অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি কমেছে ৫৭.৭১ শতাংশ।
এদিকে, শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে। ২০২৩ অর্থবছরে দেশটি থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৫৭ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ অর্থবছরে ছিল ৫০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, এই দেশ থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ১৪.৩০ শতাংশ বেড়েছে।
ভারত থেকে আমদানি ৪.৪৫ বিলিয়ন ডলার কমেছে
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আমদানির ৯২ শতাংশই হয় ভারত থেকে। এরপর ৭ শতাংশ হয় পাকিস্তান থেকে এবং অবশিষ্ট ১ শতাংশ হয় বাকি ৫ দেশ থেকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে ৯.৪৯ বিলিয়ন ডলার আমদানি মূল্য পরিশোধ করেছে, যেখানে ২০২২ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ১৩.৯৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে ভারত থেকে আমদানি প্রায় ৩২ শতাংশ কমেছে।
নিটল মোটরসের চেয়ারম্যান এবং ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ টিবিএসকে বলেন, "দুটি কারণে ভারত থেকে আমাদের আমদানি কমেছে। প্রথমত, আমাদের ডলার সংকট থাকার কারণে আমরা এমনিতেই আমদানি কমিয়ে দিয়েছি। একইসঙ্গে, ভারতে আমাদের রপ্তানিও কমেছে।"
"দ্বিতীয়, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের হাতে টাকা কমে যাওয়ায় আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমেছে। দেশীয় পণ্যের পাশাপাশি ভারতীয় পণ্যের চাহিদা কমেছে। ফলে আমদানি কমে গেছে।"
"এছাড়া, ভারত বিভিন্ন সময়ে পেঁয়াজসহ বেশকিছু পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়াও মোট আমদানিতে প্রভাব রেখেছে," যোগ করেন তিনি।
পাকিস্তানে সামগ্রিক আমদানি মূল্য পরিশোধ ২০২২ অর্থবছরের ৮০২ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় ২০২৩ অর্থবছরে ৬৯৯ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। শ্রীলঙ্কা থেকেও আমদানি কমেছে। ২০২৩ অর্থবছরে দেশটিতে ৮৯ মিলিয়ন ডলার আমদানি মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে, ২০২২ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ১৩৪ মিলিয়ন ডলার।
এছাড়া, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেপাল থেকে বাংলাদেশে আমদানির ক্ষেত্রে মিশ্র এবং হ্রাসের প্রবণতা দেখা গেছে। অন্যদিকে, আলোচ্য সময়ে ভুটান থেকে আমদানির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে।
২০২৩ অর্থবছরে আফগানিস্তান থেকেও আমদানি মূল্য পরিশোধ কমে ১২.৮০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এছাড়া, মালদ্বীপ থেকে বাংলাদেশের আমদানি সামান্য বেড়েছে।