ডিসেম্বর প্রান্তিকে ১০ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩৯,৬৫৫ কোটি টাকা
বিদায়ী বছর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ১০টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯,৬৫৫ কোটি টাকা। প্রতিটি ব্যাংকের 'ডিসক্লোজারস অন রিস্ক বেজড ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসি' (ব্যাসেল-৩) প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ফলে ঝুঁকি-ভিত্তিতে অ্যাসেট বাড়তে থাকায় মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। তবে ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি যে পরিমাণ দেখানো হচ্ছে, তার তুলনায় প্রকৃত ঘাটতি আরও অনেক বেশি। কারণ অনেক ব্যাংকের প্রায় ৪০,০০০ কোটি টাকার বেশি প্রভিশন ডেফারেল করা রয়েছে। সেগুলো ঘাটতিতে দেখানো হলে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ আরও অনেক বেড়ে যেত বলে মন্তব্য তাদের।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। 'ব্যাসেল ৩' নীতি অনুসারে, বাংলাদেশে ঋণদাতাদের তাদের রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেটস বা ঝুঁকি-ভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ বা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যে পরিমাণটি বেশি— সেটি সংরক্ষিত মূলধন হিসেবে রাখতে হবে। কোনো ব্যাংক নির্ধারিত এই পরিমাণ সংরক্ষণ করতে না পারলে, তা ওই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
ব্যাংক উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ এবং মুনাফা থেকে প্রাপ্ত একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষিত থাকে। মূলধনের ঘাটতি থাকলে ব্যাংক তার শেয়ারহোল্ডারদের লভাংশ দিতে পারে না। এছাড়া, বিদেশি ব্যাংকগুলো এসব স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা করার আগে তাদের মূলধন পরিস্থিতি বিবেচনা করে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১৪টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৩৭,৫০৬ কোটি টাকা। ওই বছরের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। তবে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও, ডিসেম্বরের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর অডিট প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে শীর্ষ পর্যায়ে থাকা ১০টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি খুঁজে পেয়েছে। ব্যাংকগুলোর প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) সরকারি-বেসরকারি ১০টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি আগের প্রান্তিকের তুলনায় ২,৩৯২ কোটি টাকা বেড়েছে।
যদিও সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে ঘাটতি আরও কম হবে, কারণ অনেক ব্যাংক ন্যূনতম রিকয়ারমেন্ট বা পরিমাণের চেয়ে বেশি মূলধনও রাখে।
ডিসেম্বরে ২০২৩ শেষে ঘাটতিতে থাকা ১০টি ব্যাংক হলো- রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। এছাড়া, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে– বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং পদ্ম ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি যত বাড়বে— এই মূলধনের ঘাটতিও বাড়বে। দেশের ব্যাংকগুলোতে আর্থিক সূচকের মান ক্রমশ অবনতির কারণে মূলধন সংকট দেখা দিয়েছে।"
তিনি বলেন, "ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মূলধন ঘাটতি আরও বেশি হবে। কারণ বর্তমানে এক ডজন ব্যাংক ডেফারেল নিয়েছে প্রায় ৪০,০০০ কোটি টাকার বেশি। তাদের ডেফারেলের যদি ৫০ ভাগও মূলধন রিকোয়ারমেন্টে যোগ হয়, তাহলে ঘাটতি বাড়বে আরও প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকা।"
তিনি আরও বলেন, "২০২৪ এর মার্চ প্রান্তিকে মূলধন ঘাটতি আরও বাড়বে। কারণ এই প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণও অনেক পরিমাণে বেড়েছে।"
বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সামগ্রিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রকাশ না করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে— রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ব্যাপক পরিমাণে বেড়েছে।
প্রতিবেদনে দেখাঁ যায়, ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০২৪ সালের মার্চ শেষে ৭৩.২০ শতাংশ বেড়ে ৮৫,৮৭০ কোটি টাকা হয়েছে, যা ২০২২ সালের একই সময়ে ৪৯,৫৭৬ কোটি টাকা ছিল।
মূলধন ঘাটতির দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫,৭৪০ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের মূলধণ ঘাটতি রয়েছে ৪,৪৫০ কোটি টাকা। এছাড়া, বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২,৯৮৫ কোটি টাকা। যদিও তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রভিশন ডিফারেল সুবিধায় রয়েছে ৫,৩৪৩ কোটি টাকা।
এদিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত আরেক ব্যাংক জনতার অডিট প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২,৭৫০ কোটি টাকা। তাদের রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেটস রিকোয়ারমেন্ট অনুযায়ী মূলধন ৬.৭৫ শতাংশ।
প্রতিবেদন বলছে, জনতা ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১৫,৩৪৬ কোটি টাকা প্রভিশন ডেফারেল সুবিধা দেওয়া রয়েছে। এই সুবিধা তুলে নেওয়া হলে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি গিয়ে ঠেকবে মাইনাস (ঋণাত্মক) ১২.৬২ শতাংশে।
মূলধন ঘটতিতে থাকা বেশিরভাগ ব্যাংক বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডেফারাল সুবিধা নিয়েছে। তাদের সকলের পরিস্থিতি অনেকটাই জনতা ব্যাংকের মতো।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "মূলধনের ঘাটতি কমানোর দুটি উপায় আছে। প্রথমত, ব্যাংকগুলোকে তাদের নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) সংগ্রহের দিকে নজর দিতে হবে। যদি এনপিএল কমানো যায়, প্রভিশন রিকোয়ারমেন্ট কমে যাবে। ফলে মূলধনের ঘাটতি কমবে।"
"দ্বিতীয়, উদ্যোক্তা পরিচালকদের নতুন পুঁজি ইনজেক্ট করতে হবে। নতুন মূলধন আসলে ঘাটতি কমে যাবে," বলেন তিনি।