ব্যাংকখাতের উন্নয়ন না হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে না: আহসান এইচ মনসুর
গবেষণা সংস্থা– পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশের ব্যাংকখাতের উন্নয়ন না হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে না। এ খাত নিয়ে গুরুত্ব-সহকারে ভাবার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকখাত থেকে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার টাকা পাচ্ছে না, ব্যবসায়ীরাও পাচ্ছেন না।
আজ সোমবার (১০ জুন) সম্পাদক পরিষদ ও সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে 'অর্থনীতির চালচিত্র ও প্রস্তাবিত বাজেট ২০২৪–২৫' শীর্ষক এ আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্টজনেরা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল- "আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, বাজেটের ব্যয়খাত সংকুচিত করা হয়েছে; কিন্তু ব্যয় কমানো হয়নি। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যে ধরনের ব্যয় সাশ্রয়ী উদ্যোগ দরকার ছিল, বাজেটে তা লক্ষ করা যায়নি।"
সরকারের ব্যয় কমানোর জন্য মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা কমিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়ে আহসান মনসুর বলেন, বর্তমানে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আরও অনেক মন্ত্রণালয় রয়েছে, যেগুলোর প্রয়োজনীয়তা বিশেষ নেই। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১১টি মন্ত্রণালয়।
তিনি বলেন, সুদহার, বিনিময় হার নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখার মতো আর্থিক ব্যবস্থাপনার নীতিগত দূর্বল সিদ্ধান্তের কারণে বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন এগুলো বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে। এ অবস্থা কমপক্ষে ৬ থেকে ৯ মাস ধরে রাখা গেলে মূল্যস্ফীতি কমে আসতে পারে।
আহসান মনসুরের মতে, "এরপরও জিনিসপত্রের দাম কমবে না, তবে মূল্যবৃদ্ধির হার কমবে। সরকার যদি বুঝে কাজ করে, তাহলে আগামী জানুয়ারি মাসের দিকে কমতে পারে। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা খুব কঠিন বিষয় নয়, ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যেই সম্ভব।"
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানো মুদ্রানীতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়। মূল্যস্ফীতি কমানো বাজেটের বিষয় নয়, যদিও বাজেট সেখানে সহযোগী ভূমিকা পালন করতে পারে। গত বছরের তুলনায় এ বাজেট সংকোচনমুখী হয়েছে; এখন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কার্যকর হলে মূল্যস্ফীতি কমবে।
"মুদ্রা বিনিময় হার বর্তমানে যেখানে আছে, আগামী কয়েক মাস সেখানেই থাকবে। এদিকে সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করা না হলে মূল্যস্ফীতি কমবে।"
প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু অসঙ্গতি আছে বলে মনে করেন আহসান মনসুর। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। ব্যাংকখাত এত দুর্বল যে আমানতের প্রবৃদ্ধি ভালো নয়। আমানতের প্রবৃদ্ধির মোট পরিমাণ ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে না। "সেখান থেকে সরকারই যদি ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়, তাহলে আর কী থাকবে!"
তিনি বলেন, অর্থনীতিতে ব্যক্তি খাতের আকার ৮৬ শতাংশ; ১৪ শতাংশ সরকারি। আমাদের হিসাবে ব্যক্তি খাত ঋণ পাচ্ছে ২৪ শতাংশ আর ৭৬ শতাংশ ঋণ পাচ্ছে সরকার। বড় অসঙ্গতি এখানেই, এটা হতে পারে না।
বিদ্যুৎ খাতকে সরকার যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছে বলে মনে করেন আহসান মনসুর। তাঁর মতে, "বিদ্যমান ক্যাপাসিটি চার্জ ও ভর্তুকি বজায় রেখে বেশিদূর এগোনো যাবে না। ভারতের আদানি গ্রুপ হোক বা দেশের সামিট গ্রুপই হোক, আমি মনে করি, এদের সঙ্গে পুনরায় দর-কষাকষি (রিনেগোশিয়েট) করতে হবে। এভাবে ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব।"
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, একটি খাতের ব্যর্থতার জন্য সরকারের ঋণের বোঝা এ পর্যায়ে এসেছে। সেটা হলো, রাজস্ব খাত। কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এই রাজস্ব ব্যবস্থা দিয়ে উন্নত হওয়া তো দূরের কথা, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়াও সম্ভব নয়। রাজস্ব আয় দ্বিগুণ করা সম্ভব। কিন্তু বাজেটে আর্থিক ও রাজস্ব খাতের সংস্কারের কথা শোনা যায়নি। শুধু মন্ত্রণালয়ে আলোচনা করলে হবে না; সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। তাঁর প্রশ্ন, "জনগণ কেন কর দেবে, যেখানে প্রায় সব সেবা পেতে উপরি দিতে হয়?"
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে স্লোগান দিয়ে বাজেট করা হয়েছে, তার আগে সরকারের নীতি পর্যালোচনায় স্মার্টনেস দরকার বলে আহসান এইচ মনসুর মনে করেন। তিনি বলেন, "আমরা চাই স্মার্ট সংস্কার কর্মসূচি, সেটা রাজস্ব নীতিতে, রাজস্ব প্রশাসনে। অথচ সেখানেই দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি। স্মার্ট বাংলাদেশের শুরুটা যেন সরকারের দিক থেকেই হয়, তাহলে জনগণ এমনিতেই স্মার্ট হয়ে যাবে।"