বিদ্যুৎ ও সারের জন্য সরকারি বন্ড ছাড়ায় বেড়েছে ব্যাংকগুলোর তারল্য
চলতি বছরের এপ্রিলে দেশের ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল গত দশ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে তা সত্ত্বেও মার্চের তুলনায় এপ্রিলে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বা ৫.৮৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা—আগের মাস মার্চে যা ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসে অতিরিক্ত তারল্য ৯ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা বেড়েছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, এপ্রিলে একদিকে ব্যাংকগুলোর আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে, অন্যদিকে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বেড়েছে। তারপরও ব্যাংকগুলোর কয়েকটি কারণে সামগ্রিক অতিরিক্ত তারল্য ও নগদ অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে।
অতিরিক্ত তারল্য বাড়ার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে, অনেক ব্যাংকের দীর্ঘদিনের সার ও বিদ্যুতের বকেয়া পাওনা বন্ডে পরিশোধ করেছে সরকার। এর ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্য বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলো সেই তারল্যই আবার ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করেছে।
ব্যাংকগুলোকে স্ট্যাটিউটরি লিকুইডিটি রেশিও (এসএলআর) হিসেবে তাদের আমানতের একটি নির্দিষ্ট অংশ সংরক্ষণ করতে হয়। আর সরকারি ও বেসরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ তাদের এ বাধ্যবাধকতা পূরণে সাহায্য করে। সে কারণে সম্প্রতি সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের অর্থ হচ্ছে, এসএলআরের বাধ্যবাধকতার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের চেয়ে বেশি তারল্য রয়েছে এখন।
ব্যাংকগুলোর গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তার জন্য স্ট্যাটিউটরি লিকুইডিটি রেশিও (এসএলআর) হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ক্যাশ ও ইনভেস্টমেন্ট সিকিউরিটিজের মাধ্যমে রাখতে হয়। সম্প্রতি এই সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের বাড়ার ফলে অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি কেনার কারণে ব্যাংকগুলো ২০২২ সাল থেকে তারল্য সংকটে রয়েছে। এর ফলে প্রায় ৩.৭৫ লাখ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। এছাড়া ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে উদ্বেগ এবং ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় অনেক গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। মূল্যস্ফীতির কারণেও গ্রাহকরা সঞ্চয় ভেঙে সংসারের খরচ মেটাতে বাধ্য হয়েছেন। এর ফলেও আমানতের প্রবৃদ্ধির গতি কমে গেছে।
গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ এবং ইনভেস্টমেন্ট সিকিউরিটিজের মাধ্যমে রাখতে হয়। ব্যাংকগুলোকে তাদের কাছে থাকা গ্রাহকের মোট আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ ৪ শতাংশ টাকা ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) হিসেবে রাখতে হয়। আর প্রথাগত ব্যাংকগুলোকে আমানতের ১৩ শতাংশ ও ইসলামী ব্যাংকগুলোকের ৫.৫ শতাংশ এসএলআর হিসেবে রাখতে হয়।
যদিও এসব বাধ্যবাধকতা পূরণ করার পরও এপ্রিল শেষে মোট অতিরিক্ত তারল্য (সিকিউরিটিজসহ) দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১.৬৩ লাখ কোটি টাকা, এবং ২০২৩ সালের জুলাইয়ে তা ছিল ১.৮০ লাখ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য বৃদ্ধির একটি বড় কারণ তারা ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ব্যাপক বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো সিকিউরিটিজে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করায় তাদের অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ বাড়ছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, 'ব্যাংকগুলো ঋণের চেয়ে এখানে [ট্রেজারি বন্ড] বিনিয়োগে এখন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। কারণ, ঋণে ১১-১২ শতাংশ সুদ পেলেও এই ঋণ আদায়ে অনিশ্চয়তা থাকে। অনেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে যায়। তবে সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করলে ব্যাংকগুলোর যেমন এসএলয়ারের বাধ্যবাধকতা পূরণ হয়, অন্যদিকে ব্যাংকগুলো যখন ইচ্ছা এ সম্পদ ভাঙাতে পারে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ন্যূনতম তরল সম্পদের (মিনিমাম রিকোয়্যার্ড অ্যাসেট) পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭১ হাজার ৫২ কোটি টাকা, যেখানে এই সময়ে মোট তরল সম্পদ ছিল ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা।
জানুয়ারিতে সরকার সার ও বিদ্যুৎ খাতে বকেয়া নিষ্পত্তির জন্য ৪০টি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের অনুকূলে ২৬ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ছেড়েছে। এই বন্ডগুলোর কুপন রেট বা সুদহার ৮.৫ শতাংশ। তবে ব্যাংকগুলো এই রেটে এসব বন্ড সংগ্রহ করে তার চেয়ে কিছু বেশি রেটে আবার সরকারকে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ঋণ দেয়।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যাংক থেকে চড়া হারে ঋণ নেওয়া শুরু করায় গত ৩ জুন প্রথমবারের মতো এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার রেকর্ড ১২ শতাংশে পৌঁছে যায়। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, সুদব্যয় বৃদ্ধির ফলে বাজেট ঘাটতি বাড়বে এবং সরকারের অর্থ পরিশোধের বোঝা বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার এক বছর আগে ছিল ৭.৭৫ শতাংশ। জুনের মধ্যে সব ধরনের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার সর্বনিম্ন ১১.৩০ শতাংশ থেকে ১২.৫৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে, যা এক বছর আগেও ৬.৭৫ শতাংশ থেকে ৮.৫ শতাংশ ছিল।
এদিকে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত নগদ তারল্যও বাড়ছে। চলতি বছরের এপ্রিল শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা, যা এক মাসে আগে ছিল ৬ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩-এর ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা, যা ২০২৩-এর জুলাইয়ে ছিল ১১ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার পরিচালক টিবিএসকে বলেন, সরকারের ভর্তুকি বাবদ বকেয়া পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর তারল্য বাড়ছে। যদিও ব্যাংকগুলোর গ্রাহক পর্যায়ে বিনিয়োগের টাকা ফেরত খুবই কম আসছে।
তিনি বলেন, 'ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করছেন না। অনেক ব্যবসায়ী ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোনকে টার্ম লোনে রূপান্তর করছে। এতে ব্যাংকগুলোর তারল্য প্রবাহ হচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমদানি ব্যাপক কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এতে কিছু কিছু ছোট প্রতিষ্ঠান ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েছে। একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি, যার কারণে মানুষজন ব্যাংকগুলোতে আমানতও বাড়াচ্ছে না। কারণ, মানুষের আয়ের সিংহহভাগই চলে যাচ্ছে তাদের দৈনিন্দন চাহিদা মেটাতে।'