জুনে ব্যাংকখাত থেকে সরকারের ধার বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি আরও চড়া হওয়ার আশঙ্কা
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ব্যাংকখাত থেকে সরকার নিট (প্রকৃত) ধার করেছে ৬৬ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। তবে এসময়ে ব্যাংক থেকে অর্থ ধারের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র প্রায় ৪০ শতাংশ নেয় সরকার। বেসরকারি খাতে ঋণের সহজলভ্যতা তখনো পর্যন্ত ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা না দেওয়ায়- এটা হয়তো ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের সন্তুষ্ট করতে পারত।
তবে মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানেই বদলে যায় পরিস্থিতি, যখন চলতি জুনের প্রথম ১৩ দিনেই ব্যাংকগুলো থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ধার করে সরকার। আগের ১১ মাসে নেওয়া ধারের চেয়ে যা অর্ধেকের বেশি। এরমধ্যে আবার ১৫ হাজার কোটি টাকাই দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন সরাসরি সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ড কিনছে না, ফলে এখানে নতুন করে ডিভলভমেন্ট বাড়ছে না। বরং বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাডভান্স ও ওভারড্রাফটের মাধ্যমে সরকারকে ধার দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের টাকা ধারের তিনটি উপায়ের একটি হচ্ছে ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স। অন্য দুটি হচ্ছে– ওভার ড্রাফট ও ডিভলভমেন্ট।
সরকারের রাজস্ব ও ব্যয়ের স্বল্পমেয়াদি ঘাটতি পূরণের জন্য নেওয়া সাময়িক ঋণ হচ্ছে ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স। অন্যদিকে ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্সের সীমা যখন ছাড়িয়ে যায়– তখন উচ্চ সুদে জরুরী তহবিল দিতে ওভার ড্রাফট ব্যবহার করা হয়।
মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দিতে পারে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের তাৎক্ষণিক আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে এসব উপায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও– এগুলো ব্যবহার করার ফলে উল্লেখযোগ্য বেশকিছু প্রভাব তৈরি হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরকারকে অর্থ ধার দেওয়ার এই পদ্ধতির সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর এটিকে কার্যত টাকা ছাপানো বলে মন্তব্য করেন।
তাঁর মতে, ডিভলভমেন্ট, 'ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স বা ওভার ড্রাফট যেভাবেই সরকারকে টাকা ধার দিক না কেন – কেন্দ্রীয় ব্যাংককে টাকা ছাপিয়েই এসব ধার দিতে হয়। এগুলোর ম্যাক্রো-ইমপ্যাক্ট (সামগ্রিক প্রভাব) একই।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার টাকা ছাপিয়ে লোন নিলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি আর থাকবে না মন্তব্য করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ধার মূল্যস্ফীতিকে কমতে বাধা দেবে। আমরা এখন যে মূল্যস্ফীতি দেখছি, সেখানে গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ধার দেওয়ার একটা বড় প্রভাব রয়েছে। মূল্যস্ফীতি তখনই কমবে যখন সত্যিকারের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেওয়া হবে। শুধু শুধু সংকোচনমূলক বললেই হবে না।
তিনি সতর্ক করে বলেন, ব্যাংক খাত থেকে ধার করার ধারবাহিকতা অব্যাহত থাকলে লেন্ডিং রেট (বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর অর্থ ধারে সুদের হার) আরও বাড়তে পারে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আরও চাপের মধ্যে পড়বে।
মূল্যস্ফীতি কমাতে সংকোচনমূলক মুদ্রনীতিকে কেবল ঘোষণায় সীমাবদ্ধ না রেখে– এটির বাস্তব প্রয়োগ দরকার বলেও মন্তব্য করেন আহসান মনসুর।
'মুদ্রানীতির পরিপন্থী'
এবিষয়ে একই রকম দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী। তাঁর মতে, সরকারকে ধার দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে পদ্ধতি বা উপায়ই ব্যবহার করুক না কেন, তাতে অর্থনীতিতে তারল্য চলে আসে, ফলে সেটা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পরিপন্থী হয়ে ওঠে।
"ফলে স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতির ওপর এর কিছু প্রভাব পড়ে। মূল্যস্ফীতিকে চালিত করার পেছনে অন্যান্য আরও অনুঘটকও কাজ করে, তাই মূল্যস্ফীতির কতটুকুর জন্য এই তারল্য কাজ করছে সেটা বলা কঠিন।"
টিবিএসকে বলেন মুজেরী আরও বলেন, বেশিরভাগ ব্যাংক তারল্য সংকট ও আমানত সংগ্রহে দুর্বল অবস্থায় থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাধ্য হয়ে সরকারকে অর্থ ধার দিতে হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ১১ মাসে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ৮১ হাজার ৭০২ কোটি টাকা ধার করে ১৪ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। এতে নেট বা প্রকৃত ধারের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৬ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ২৭ শতাংশ কম।
তবে সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, জুনে ৮৯ হাজার ২১১ কোটি টাকা ধার করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত ব্যাংকখাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া তুলনামূলকভাবে কম ছিল, তবে জুনের শুরু থেকে তা অনেকটা বেড়েছে।
এপর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ধার ১ লাখ কোটি টাকা পার করেছে। কেবলমাত্র জুন মাসের প্রথম ১৩ দিনেই ব্যাংকখাত থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ধার বাড়িয়েছে সরকার। এরমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী, ব্যাংকখাত থেকে ধার করার লক্ষ্যমাত্রা ২৩ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মে মাস শেষের ব্যালেন্স অনুযায়ী সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধার কিছুটা পরিশোধ করেছে। তবে জুন মাসের শুরু থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার বাড়তে শুরু করেছে। পরিশোধ করা টাকা তুলে নেওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন ধারও নিচ্ছে সরকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ধার দেওয়ার জন্য নতুন করে টাকা ছাপানো হচ্ছে না।
বিল ও বন্ড কেনায় আগ্রহ কম ব্যাংকগুলোর
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলো বেশি সুদের হার দাবি করায় সরকারকে ব্যাংক খাত থেকে ধার দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম– ট্রেজারি বিল ও বন্ডের একটা অংশ অবিক্রিত থাকছে।
যেমন ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গত ২৩ জুন তিন বছর থেকে এক বছর ম্যাচুরিটির ট্রেজারি বিল নিলামে তোলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তবে অংশগ্রহণকারী ব্যাংকগুলো আরও উচ্চ সুদ দাবি করায়, শেষপর্যন্ত নিলাম থেকে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের শুরুর দিকে ট্রেজারি বিলের সুদের হার ছিল সর্বোচ্চ ৮.৬০ শতাংশ, এখন সেটি বেড়ে ১২ শতাংশ হয়েছে। ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার ছিল ৯.১০ শতাংশ, যেটি এখন বেড়ে হয়েছে ১২.৭৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তা বলেন, সুদ ব্যয়ের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার সুদের হার বর্তমান রেটের চেয়ে বেশি দিতে চাচ্ছে না। একারণে নিলামে তোলা ট্রেজারি বিল ও বন্ড পুরোপুরি বিক্রি করা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও একুশে পদকজয়ী অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, এক মাসেই যদি সরকার ব্যাংক খাত থেকে এতো বেশি ধার করে তাহলে 'ক্রাউডিং আউট' হবে। অর্থাৎ, বেসরকারি খাত ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত ঋণ পাবে না। এটা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে দেবে।
আগামী অর্থবছরে সরকারকে কর-জিডিপি অনুপাত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাড়াতে হবে মন্তব্য করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কর সংগ্রহ করতে পারলে সরকারের ব্যাংকখাত থেকে অতিরিক্ত ধার নেওয়ার চাপ কমতে পারে।