চট্টগ্রাম বন্দরে ‘অন্যায্য’ ক্ষতিপূরণ মাশুলের সম্মুখীন আমদানিকারকরা
গত সপ্তাহে দেশব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকার ঘটনায় – বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরে – জাহাজ থেকে পণ্য লোডিং-আনলোডিংও ব্যাহত হওয়ায় তৈরি হয় অচলাবস্থা। এই দেরীর জন্য দায় না থাকলেও – আমদানিকারকদের ওপর বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ মাশুল (ডেমারেজ চার্জ) ধরা হয়েছে।
এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই), তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-সহ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনগুলো এসব মাশুল মওকুফের অনুরোধ করেছে।
কিন্তু, তাতে রাজি হয়নি বন্দর কর্তৃপক্ষ, বরং আমদানিকারকদের পৃথক পৃথকভাবে মওকুফের আবেদন করতে বলেছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, যদি আমদানিকারকরা আলাদা আলাদা চালানে আবেদন করতে হয়, সেক্ষেত্রে আবেদন এবং অনুমোদন প্রক্রিয়ায় আরো সময় লাগবে। এতে করে কনটেইনার ডেমারেজ টাইম বাড়ায় তাদের ব্যয় আরও বাড়বে।
বন্দর কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় এরমধ্যেই তৈরি হয়েছে বড় ধরনের ব্যাকলগ, অর্থাৎ সময়মতো ডেলিভারি না হওয়া কনটেইনার জড়ো হয়েছে। বর্তমানে বন্দরে কনটেইনার রয়েছে ৪১ হাজার টিইইউএস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের), যা স্বাভাবিক সময়ে থাকে ৩০ হাজার টিইইউএস। কনটেইনারের এই জটে ডেলিভারিতে আরও বিলম্বের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যার আমদানিকারকদের ব্যয় আরও বাড়বে। ফলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা এই সমস্যার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এরমধ্যেই টালমাটাল অবস্থায় থাকা ব্যবসাগুলো।
ব্যবসার বাড়তি এই ব্যয়ের ভার শেষপর্যন্ত চাপবে ভোক্তাদের ওপরে, যাতে আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে মূল্যস্ফীতি, যা বর্তমানে দুই অঙ্কের ঘরের কাছাকাছি রয়েছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি ওমর হাজ্জাজ টিবিএসকে বলেন, 'খালাসে কেস টু কেস নয়, আটকে যাওয়া আমদানি কনটেইনার খালাসে– আমরা সব কনটেইনারে ১৫ দিনের স্টোর রেন্ট (স্টোরেজ রেন্ট) মওকুফের দাবী জানিয়েছি। এই ইস্যু নিয়ে ইতোমধ্যে এফবিসিসিআই-সহ অন্যান্য ট্রেড বডি চিঠি দিয়েছে। আমরাও চট্টগ্রাম চেম্বারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে এই বিষয়ে একটি চিঠি দেব।'
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, জাহাজ থেকে আমদানি পণ্যের কনটেইনার চার দিন বন্দরের ইয়ার্ডে বিনা ভাড়ায় রাখার সুযোগ পান আমদানিকারকরা। এরপর ২০ ফুট লম্বা সাইজের একটি কনটেইনারের জন্য প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন ৬ মার্কিন ডলার স্টোরেজ রেন্ট বা ভাড়া গুনতে হয়।
তার পরবর্তী সপ্তাহে প্রতিদিন একই সাইজের কনটেইনারে ১২ ডলার, এবং ২১তম দিন থেকে দৈনিক ২৪ ডলার হিসেবে ভাড়া দিতে হয় আমদানিকারকদের। ৪০ ফুট সাইজের কনটেইনারের ক্ষেত্রে এর দ্বিগুণ ভাড়া পরিশোধ করতে হয়।
গত এক বছরে দুটি ঘূর্ণিঝড়, ঈদের টানা ছুটি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সবশেষ কোট সংস্কার আন্দোলনের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে মোট ২৩ দিন।
ভাড়া মওকুফ চায় পোশাক শিল্প
বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন- বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, বন্দরের ক্ষতিপূরণ মাশুল মওকুফের অনুরোধ জানিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছে এফবিসিসিআই। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবও একইরকম নির্দেশনা দিয়েছেন, তবে মন্ত্রণালয় তার প্রেক্ষিতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
টিবিএসকে তিনি বলেন, 'অন্যায্য এই ডেমারেজের খরচ খুবই হতাশাজনক। আমাদের কীইবা করার আছে?' বন্দর থেকে মাল খালাসে গত বৃহস্পতিবার তিনি ক্ষতিপূরণ মাশুল দিয়েছেন বলেও জানান।
চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি কনটেইনার টার্মিনালের মধ্যে দুটি পরিচালনা করে সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক নাজমুল হক টিবিএসকে বলেন, কনটেইনার ডেলিভারি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে, তবে ব্যাকলগে জমে যাওয়া অতিরিক্ত কনটেইনার ডেলিভারি দিয়ে পূর্বের অবস্থায় ফিরতে আরও অন্তত ১০ দিন সময় লাগবে।
এদিকে গত ১৯ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের শেড চার্জ মওকুফের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয় বিজিএমইএ। এছাড়া শিপিং চার্জ, ব্যাংকের সুদসহ অন্যান্য ব্যয় মওকুফের জন্যও শিপিং এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি।
বন্দর কর্মকর্তাদের মতে, স্টোরেজ ভাড়া মওকুফের জন্য আমদানিকারক নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারেন। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বন্দর কর্তৃপক্ষের মতামত এবং তথ্য চায় মন্ত্রণালয়। বন্দর ইয়ার্ড থেকে ডেলিভারি নেওয়ার দিন পর্যন্ত স্টোরেজ ভাড়া মওকুফ করতে পারে মন্ত্রণালয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, বর্তমানে সম্পূর্ণ স্টোরেজ ভাড়া পরিশোধ করেই কনটেইনার ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে। 'এটি মওকুফের বিষয়টি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। ভাড়া মওকুফের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশনা এলে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।'
বন্দরের বর্তমান পরিস্থিতি
ওমর ফারুক আরো বলেন, বর্তমানে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি কনটেইনার ডেলিভারি হচ্ছে। শুক্রবারও প্রায় ৩,৫০০ টিইইউ কনটেইনার ডেলিভারি হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বন্দর ইয়ার্ডে কনটেইনারের সংখ্যা ৩০ হাজারে নেমে আসবে।
তিনি জানান, বন্দরের ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার টিইইউস, এবং বাধামুক্তভাবে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৫ শতাংশ ফ্রি ক্যাপাসিটি রাখতে হয়। স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ৩,৫০০ থেকে ৪,৫০০ টিইইউ কনটেইনার ডেলিভারি হয়। তবে দেশব্যাপী বিক্ষোভ ও সহিংসতার মধ্যে তা প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসে।
এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে শুল্কায়ন শুরু করায় – ধীরে ধীরে ডেলিভারির সংখ্যা বাড়তে থাকে। বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) সকাল আটটা থেকে শুক্রবার (২৬ জুলাই) সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় – ৫ হাজার ২০১ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের রেকর্ড হয়।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, চট্টগ্রামের ১৯টি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) প্রায় প্রায় ৬,৩০০ টিইইউএস রপ্তাানি পণ্যবাহী কনটেইনার রয়েছে। এছাড়া ডিপোগুলোতে আমদানি পণ্যবোঝাই ১১ হাজার, এবং খালি কনটেইনার আছে ৪৯ হাজার টিইইউস।
জরিমানা মওকুফ চান জাহাজ মালিকরা
শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, সাধারণত দুই দিনে লোডিং-আনলোডিং সম্পন্ন করে একটি জাহাজ বন্দরের জেটি ত্যাগ করে। বর্তমানে সেখানে চার থেকে পাঁচ দিন লাগছে। জেটিতে প্রতিদিনের বাড়তি অবস্থানের জন্য অন্তত ২০ হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হবে জাহাজ মালিকদের।
এই প্রেক্ষাপটে, চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে বাড়তি সময় জাহাজ অবস্থানের মাশুল মওকুফের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, পণ্য আমদানিতে কনটেইনারের শিপিং চার্জের ফ্রি টাইম ১৪ দিন। এরপরেও বন্দরে জাহাজ বেশি সময় অপেক্ষার কারণে আমাদের বাড়তি ব্যয় গুনতে হবে।