১ হাজার কোটি টাকার বন্ড বিক্রি করতে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন সালমান এফ রহমান
প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বন্ডে অর্থায়ন করতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু তাদের ধারণাও ছিল না, গত জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে তিনি তার নতুন রিয়েল এস্টেট কোম্পানি শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের (এসটিএল) জন্য এক হাজার কোটি টাকার বন্ডের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে কোন পর্যায়ে যাবেন।
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান এবং পরে সংসদ সদস্য হওয়া সালমান রহমান ১৩ আগস্ট গ্রেপ্তার হয়েছেন। ব্যক্তিগত লাভের জন্য সরকারি পদের অপব্যবহার করে তিনি ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।
বিপুল পরিমাণে ব্যাংক ঋণ নেওয়া, ঋণখেলাপি এবং শেয়ার বাজারে কারসাজির জন্য কুখ্যাত সালমান এফ রহমানের এ 'গুণ' বন্ড বিক্রিতেও বেশ প্রকাশ পেয়েছিল।
বিশেষজ্ঞ এবং বিনিয়োগ ব্যাংকারেরা বলেছেন, আর্থিক অব্যবস্থাপনার কুখ্যাতি থাকলেও সালমান তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন নিয়ন্ত্রক, কোম্পানি এবং বিনিয়োগকারীদের প্রভাবিত করে বন্ড বিক্রয় নিশ্চিত করেছিলেন।
তার এ কূটকৌশলের কেন্দ্রে রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। এ ব্যাংকে সালমান ও তার পরিবার ৫ শতাংশেরও কম শেয়ারের মালিক। তারপরও তিনি ব্যাংকটির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
৩১ জুলাইয়ের হিসেব পর্যন্ত সরকারের এ ব্যাংকে শেয়ার ৩২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বাকি অংশের মালিকানা সাধারণ জনগণ এবং সালমানসহ অন্যান্য বিনিয়োগকারীদের।
প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা হিসেবে সালমানের সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি এসটিএল-এর জন্য বন্ড লায়াবেলিটি হিসেবে কেবল ন্যূনতম সাড়ে ১০ কোটি টাকা ফিয়ের বিনিময়ে আইএফআইসি যেন এক হাজার কোটি টাকা (সুদাসলে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা) গ্যারান্টি দেয়, সে ব্যবস্থা করেছিলেন।
গত বছরের অক্টোবরে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য এসব বন্ডকে এমনভাবে বাজারজাত করা হয়েছিল, যাতে মনে হয় এগুলো সালমানের কোম্পানি এসটিএল-এর পরিবর্তে আইএফআইসি ব্যাংক নিজেই ইস্যু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ চুক্তির মাধ্যমে সালমানের স্বার্থরক্ষার বন্দোবস্ত করতে গিয়ে ব্যাংকটির আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মাহমুদ ওসমান ইমাম বলেন, 'বন্ড গ্যারান্টি ব্যাংকের জন্য একটি বৈধ ব্যবসা তখনই হবে, যদি ঋণগ্রহীতার ঋণযোগ্যতা ঝুঁকিকে ন্যায্যতা দেয় এবং ফি-এর সঙ্গে রিস্ক-রিওয়ার্ডের অনুপাতের প্রতিফলন থাকে।'
তবে অধ্যাপক ইমাম স্বার্থের সংঘাতের (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) বিষয়টির উল্লেখ করে বলেন, সালমানের মালিকানাধীন সদ্যগঠিত কোম্পানি এসটিএল এত বড় বন্ড গ্যারান্টি পাওয়ার যোগ্য ছিল না।
১৯৯০-এর দশকে সালমান এফ রহমানের বিভিন্ন কোম্পানির ইস্যু করা ডিবেঞ্চার ২০২১ সাল পর্যন্ত খেলাপি ছিল। তবুও তিনি তিন হাজার কোটি টাকার সুকুক ইস্যুসহ আরও বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া অব্যাহত রাখেন।
তার এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিয়ে ধারণা রাখা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তাকে আর্থিক গ্যারান্টি দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। যার কারণে তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ডে বিনিয়োগে বাধ্য করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রভাবিত করেছিলেন।
মৌখিকভাবে ব্যাংক এবং অন্যান্য কিছু বড় বিনিয়োগকারীকে সুকুক বন্ডে বিনিয়োগ করতে বাধ্য করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারেরা জানলেও তখন ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ এ বিষয়ে কথা বলেননি।
এসটিএল বন্ডের জন্য সালমান প্রাতিষ্ঠানিক যাচাই-বাছাইকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তার পরিবর্তে একটি বিপণন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বন্ডটিকে 'আইএফআইসি আমার বন্ড' নামে প্রচার করা হয়।
ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে চালানো এ ক্যাম্পেইনের ফলে ১২ শতাংশ বার্ষিক রিটার্নের প্রতিশ্রুতিতে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ বন্ডটিতে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হন।
আইএফআইসি ব্যাংকের ইস্যু করা আমার বন্ড একটি জিরো-কুপন বন্ড।
কুপন বন্ডে বিনিয়োগকারীরা অভিহিত মূল্যে বন্ড ক্রয় করেন, নির্দিষ্ট সময় পরপর সুদ পান এবং ম্যাচিউরিটির পর মূল অর্থ ফেরত পান। অন্যদিকে জিরো-কুপন বন্ড থেকে কোনো সুদ পাওয়া যায় না।
তার পরিবর্তে বিনিয়োগকারীরা একটি ছাড়মূল্যে জিরো-কুপন বন্ড কেনেন এবং ম্যাচিউরিটির পরে অভিহিত মূল্যে মূলধন ফেরত পান।
সালমান এফ রহমান বর্তমানে পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। এদিকে এসটিএল এবং আইএফআইসি ব্যাংকে তার মুখপাত্ররা বন্ডহোল্ডারদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন।
আইএফআইসি'র কোম্পানি সেক্রেটারি মো. মোকাম্মেল হক বলেন, বন্ডে গ্যারান্টি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ব্যাংকটির শীর্ষ ব্যবস্থাপকেরা নিয়েছিলেন। আর আইএফআইসি-এর বোর্ড তা অনুমোদন করেছিল।
মোকাম্মেল হক বিষয়টিতে সালমান এফ রহমানের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে অস্বীকার জানিয়ে এ বিষয়ে আইএফআইসি ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কাছে জানতে চাওয়ার পরামর্শ দেন।
তৎকালীন এমডি শাহ আলম সারওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। আইএফআইসি ব্যাংকের বর্তমান এমডি সৈয়দ মনসুর মুস্তাফাও মন্তব্যের অনুরোধে কোনো সাড়া দেননি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঋণখেলাপির কারণে সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালক পদ হারান। এছাড়া ব্যাংকের কর্মকর্তারা বোর্ডের খোলনলচে বদলে ফেলার দাবি জানিয়েছেন।
এসটিএল-এর কোম্পানি সেক্রেটারি কায়সার আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'বন্ডহোল্ডারদের মোটেও চিন্তা করার দরকার নেই। আমরা এখনও নিয়মিত সুদ দিচ্ছি। আমাদের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে গ্যারান্টার হিসেবে আইএফআইসি ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করবে।'
উল্লেখ্য, আমার বন্ডের ৯৯ শতাংশের বেশি ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল।
বন্ডের তথ্য স্মারক অনুসারে, এসটিএল-এর মোট সম্পদ ছিল ৩৩৫ কোটি টাকা।
সিকিউরিটিজ নিয়ন্ত্রকের সাবেক প্রধান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকীসহ বিশেষজ্ঞরা ঝুঁকিপূর্ণ বন্ড অনুমোদনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
'আমি অবাক হয়েছি যে, বিএসইসি ইস্যুকারী কোম্পানির সম্পদকে ব্যাপকভাবে ছাড়িয়ে গিয়ে বিশাল পরিমাণে বন্ড অনুমোদন করেছে। কোম্পানিটির কোনো ব্যবসায়িক ট্র্যাক রেকর্ড ছিল না,' ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী টিবিএসকে বলেন।
অবশ্য নিয়ন্ত্রকদের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাদের নিয়োগ ও চাকরির নিরাপত্তার জন্য সালমান এফ রহমানের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল ছিলেন — এ কথা তখনো তেমন গোপনীয় ছিল না।
একমাত্র কোম্পানি হিসেবে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতি পেয়েছিল, যা একচেটিয়া বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে সে সময় ১০০ কোটি টাকার বেশি লাভ করেছিল।