কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বন্ড নিয়ে খেলা: কেউ কেউ মুনাফা করলেও, মূল্যস্ফীতিই বেড়েছে সবার জন্য
ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ, তার বিপরীতে অর্থ ধার নেওয়া, একইসাথে কোনো ধরনের ঝক্কি ছাড়াই ৪ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফার সুযোগ— এভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান ব্যাংকগুলোকে আকর্ষনীয় এক সুযোগ দেন।
সেসময় ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছিলেন, এই মুদ্রানীতি এককথায় টাকা ছাপানো, যা অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপকে বহুগুণে বাড়াবে— এবং, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি হ্রাসের যে লক্ষ্য, তার পরিপন্থী। কিন্তু, এই হুঁশিয়ারি কানে তোলা হয়নি।
এই কৌশলের ফলশ্রুতিতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩২ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। যা আগের সাত বছরে দেওয়া মোট ধারের পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে।
ধার করা এসব তহবিলের উল্লেখযোগ্য অংশই সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ড কিনে বিনিয়োগ করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এভাবে তারা সহজে মুনাফা আয়ের করেছে, কারণ বিল ও বন্ডগুলোয় মেয়াদের ওপর ভিত্তি করে নিশ্চিত রিটার্ন ছিল ১.৬ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত। বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব কথা জানান টিবিএসকে।
দেশের পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত ব্যাংক ৩৬টি, এরমধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ২৩টি ব্যাংক তাদের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এরমধ্যে ১৭টি ব্যাংক ঋণ প্রদান ও সরকারি সিকিউরিটিজ থেকে মুনাফায় প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে; এমনকী কিছু ব্যাংক ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ থেকে ১০০ শতাংশের বেশি মুনাফার কথাও জানায়।
নাম না প্রকাশের শর্তে, বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান বলেন, "যেকোনো ব্যাংকের জন্য এটা কোনো ধরনের চেষ্টা ছাড়াই আয়ের সহজ রাস্তা। তার চেয়েও উদ্বেগের বিষয়– এর কোনো সীমা ছিল না, এতে বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ছিল– যেটা মূল্যস্ফীতির আগুনে আরও ঘি ঢেলেছে।"
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "রেপো বা রিফাইন্যান্স (পুনঃঅর্থায়ন) স্কিম যেভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থায়ন করুক না কেন, এটা শেষপর্যন্ত মানি ক্রিয়েট (টাকা তৈরি) করে। ব্যাংকিং সিস্টেমে আমানত বেড়ে যাওয়ার মাধ্যমেই এই মানি ক্রিয়েশন হয়।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে একটি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, যার লক্ষ্যই ছিল বাজারে টাকার সরবরাহ কমানো। কিন্তু, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকালাপ ছিল ঠিক তার উল্টো। রেপোর মাধ্যমে ব্যাপক ধার দেওয়ার কারণে, টাকার সরবরাহই বেড়েছে, যেটা মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার পরিবর্তে আরও উস্কে দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ধার দেওয়া মোট অর্থের মধ্যে ৩২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে রেপো ও অন্যান্য তারল্য সহায়তার মাধ্যমে। একইসময়ে ইসলামিক বা শরীয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংকগুলো ধার করেছে ১ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা।
আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ধারের পরিমাণ অনেক বেশি, যখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১৩ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা ধারে নিয়েছিল, আর ইসলামী ব্যাংকগুলো নিয়েছিল ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। সবমিলিয়ে মোট ধারের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা।
উচ্চপদস্থ ট্রেজারি কর্মকর্তারা বলেছেন, ২৪টি প্রাইমারি ডিলার ব্যাংক সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করে, তবে মূলত এসব বিনিয়োগের তহবিল আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই।
বেসরকারি একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান টিবিএসকে বলেন, প্রাইমারি ডিলার ব্যাংক হিসেবে এসব ব্যাংক সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড কিনতে বাধ্য, যেগুলোতে মেয়াদের ওপর ভিত্তি করে ১১ দশমিক ৬০ থেকে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দেওয়া হয়। এরপরে এসব বিনিয়োগের বিপরীতেই রেপো ও অন্যান্য তারল্য সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আরেকজন ট্রেজারি কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের থেকে অর্থ ধারের ক্ষেত্রে ৮.৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দেয় ব্যাংকগুলো, এরপর এসব তহবিল দিয়ে ট্রেজারি বিল ও বন্ড কিনে ১.৬ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করে। এটি তাঁদের ট্রেজারি ব্যবস্থাপনার প্রধান কৌশল।
বাংলাদেশ ব্যাংক কী মানি প্রিন্টিং করছে?
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোকে এক দিন থেকে শুরু করে ১৮০ দিনের জন্য ধার দেওয়া হয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ধারের টাকাগুলো ফেরত আসে। তাই পুরো টাকাটাকে মানি প্রিন্টিং (বা টাকা ছাপানো) হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক অর্থবছরে গড়ে ২৪০টি রেপো অকশন করে থাকে। অর্থাৎ, পুরো টাকাটাকে ২৪০ দিয়ে ভাগ করলে একটা গড় পাওয়া যাবে, যেটি পুরো বছরই বাজারে বিদ্যমান ছিল। এই গড়টিকে মানি প্রিন্টিং হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সে হিসাবে, মানি প্রিন্টিং ১৩ হাজার ২৪০ কোটি টাকার মতো হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে বলা যেতে পারে বলে জানান তিনি।
তবে, মানি প্রিন্টিং এর অঙ্কটা আরো বড় হতে পারে মন্তব্য করে একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার চলতি ২০২৪ সালের শুরুতে বিদ্যুৎ ও সারের দেনা মেটাতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার স্পেশাল পারপাস বন্ড জারি করে।
"এসব বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রেখে ধার নিতে পারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। নগদ টাকার সংকট থাকায় সিংহভাগ ব্যাংকই এসব বন্ডের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নিচ্ছে। ফলে এই ২০ হাজার কোটি টাকা স্পষ্টতই মানি প্রিন্টিং," তিনি ব্যাখ্যা করেন।
এই ব্যাংকার আরও বলেন, নানা সমালোচনা হওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি প্রিন্ট বা টাকা ছাপিয়ে দেওয়ার বদলে ব্যাংকগুলোকে ছাপিয়ে টাকা ধার দিয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্বৃত্তপত্রে (ব্যালেন্স শিট) একদিকে যেমন সরকারি ট্রেজারি বিল বেড়েছে, অন্যদিকে নগদ টাকার পরিমাণ কমেছে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মানি ক্রিয়েশনের কারণে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলতে কিছুটা সময় প্রয়োজন হয়। তবে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব সবথেকে বেশি।
রেপো ও ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহারের পার্থক্যের কারণে ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে মন্তব্য করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, "ভালো সুদহারে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ঝুঁকি-মুক্ত বিনিয়োগের সুযোগ থাকলে ব্যাংকগুলো কেন প্রাইভেট সেক্টরে লোন দেবে? ফলে ব্যাংকগুলো একবার ট্রেজারি বিল কিনে সেটা জমা রেখে রেপো নেবে। আবার সেই টাকা দিয়ে ট্রেজারি বিল কিনবে। এভাবে একটা সাইকেল (চক্র) তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেখতে হবে, ব্যাংকগুলোকে যে তারল্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, সেটা পাওয়ার যোগ্যতা ব্যাংকগুলো রাখে কিনা।"
রেপোতে ধার দেওয়া কমানোর জন্যই সুদহার করিডর (আইআরসি) করা হয়েছিল উল্লেখ করে জাহিদ হোসেন বলেন, "এই করিডোর করার কারণে ব্যাংকগুলোকে ধার নেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হার ৮.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার সুযোগ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে সাবেক গভর্নর সুযোগটি নেননি। সম্প্রতি নতুন ম্যানেজমেন্ট আসার পর ব্যাংকগুলোকে ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে নীতি সুদহারের চেয়ে বেশি সুদ চার্জ করা হচ্ছে। এটা ব্যাংকখাতের জন্য ভালো সিদ্ধান্ত।"
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)-র চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, বেশকিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে পলিসি রেট (নীতি সুদহার) এবং ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহারের পার্থক্য ৩০০ বেসিস পয়েন্টের বেশি। এটিকে অবশ্যই কমিয়ে নিয়ে আসা উচিত।
ব্যাংকগুলোকে যেভাবে টাকা ধার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাময়িক তারল্যের সমস্যা দূর করতে এবং অর্থনীতিতে টাকার সরবরাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত ১ দিন (ওভারনাইট), ৭, ১৪ ও ২৮ দিনের জন্য রেপোর মাধ্যমে টাকা ধার দেয়।
এছাড়া, নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক স্পেশাল রেপোর মাধ্যমেও ধার দেয়।
রেপো সুবিধা ছাড়াও, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রাথমিক ডিলার (পিডি) ব্যাঙ্কগুলোকে নিলামে বরাদ্দকৃত জি-সেকের বিপরীতে ইস্যুর তারিখ থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত অ্যাসিয়র্ড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) প্রদান করে। এভাবে ব্যাংকগুলোকে অ্যাসিয়র্ড রেপো এবং স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) দেয়।
লিকুইডিটি বা তারল্য ব্যবস্থাপনাকে সমর্থন ও আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও গভীর করার জন্য, ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশে শরীয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য ইসলামিক ব্যাংকস লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটি (আইবিএলএফ) চালু করে।
আইবিএলএফ এর মেয়াদ হচ্ছে ১৪ দিনের, এবং এজন্য যোগ্য বিবেচিত সিকিউরিটিজগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের বিনিয়োগ সুকুক বা বিজিআইএস।
এরপরে ২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকগুলোর জন্য ৭, ১৪ এবং ২৮ দিনের জামানতযুক্ত মুদারাবা লিকুইডিটি সাপোর্ট (এমএলএস) চালু করে। এছাড়াও, বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যাংকগুলোকে বিশেষ তারল্য সহায়তা (এসএলএস) প্রদান করে।