পদ্মা ব্যাংক থেকে ৮৭৪ কোটি টাকা জলবায়ু তহবিল পুনরুদ্ধারে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার পদ্মা ব্যাংকের কাছে আটকে থাকা ৮৭৪ কোটি টাকা জলবায়ু তহবিল মূলধন এবং সুদসহ পুনরুদ্ধারের উপায় খুঁজবে।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের মতে, পদ্মা ব্যাংক, যা পূর্বে ফারমার্স ব্যাংক নামে পরিচিত ছিল সেটি গত ছয় বছর ধরে ট্রাস্টের স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) ওপর কোনো সুদ প্রদান করেনি।
বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) টিবিএসকে বলেন, পরবর্তী উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে এবং সেখান খানে পদ্মা ব্যাংক থেকে তহবিল উদ্ধারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান, মতিঝিল ও গুলশান সাউথ অ্যাভিনিউ শাখায় এক বছর মেয়াদে ৫০৮ কোটি টাকা এফডিআর করা হয়।
তিনি বলেন, "মেয়াদ শেষে সুদাসল পরিশোধ না করায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত এটি নবায়ন করা হয়। ঐ সময় পর্যন্ত কয়েক দফায় পদ্মা ব্যাংক মাত্র ৮০ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। তারপর এফডিআর আর নবায়ন করা হয়নি।"
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর পদ্মা ব্যাংক উল্লেখযোগ্য অনিয়মের কারণে তারল্য সংকটের মুখোমুখি হয়।
তবুও, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের মতো সরকারি সংস্থাগুলো উচ্চ সুদের প্রলোভনে পদ্মা ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে। এই আমানতের একটি বড় অংশ এখনো পুনরুদ্ধার করা যায়নি।
মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ''২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমরা বারবার ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের সাথে সভা করেছি এবং চিঠি দিয়েও টাকা ফেরত চেয়েছি। কিন্তু ব্যাংক সুদ বা আসল বাবদ কোন টাকা দেয়নি। আমাদের হিসাবে ব্যাংকটির কাছে সুদাসলে পাওনার পরিমাণ ৮৭৩.৮১ কোটি টাকা এবং আমরা পুরো টাকা ফেরত চাই।"
কীভাবে এই টাকা ফেরত নেওয়া হবে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "ব্যাংকটির অবস্থা যদিও ভালো না, তবুও আমাদের পাওনা অর্থ উদ্ধার করতে হবে। সরকার কীভাবে এই অর্থ আদায় করবে, সে বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নেবে।"
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, "বিভিন্ন সময় দেশের আর্থিকখাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি হলেও, কোনো ব্যাংক থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রিসভা কিংবা উপদেষ্টা পরিষদের সভায় কখনো আলোচনা হয়নি।"
অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের তহবিল আটকে রয়েছে পদ্মা ব্যাংকে
পদ্মা ব্যাংকে বছরের পর বছর ধরে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ আমানত আটকে থাকলেও ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান নাফিজ সারাফাত রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে দীর্ঘমেয়াদে নবায়ন সুবিধা নিয়েছেন। তিনি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের অর্থ ফেরত চাওয়ার অনুরোধ আমলে না নিয়ে বছরের পর বছর অর্থ আটকে রেখেছেন বলে জানিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা।
পদ্মা ব্যাংকে আটকে থাকা ১৭৯ কোটি টাকা ফেরত পেতে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ জীবন বীমা করপোরেশন পদ্মা ব্যাংকে ১০৯ কোটি টাকা জমা করেছিল। ২০১৮ সালের মধ্যে সুদ বেড়ে সেই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৫ কোটি টাকা।
তখন থেকে আমানত নগদায়নের জন্য পদ্মা ব্যাংককে ৩১টি চিঠি দিয়েও টাকা ফেরত পায়নি জীবন বীমা করপোরেশন। অবশেষে বাধ্য হয়ে পদ্মা ব্যাংকের প্রস্তাব অনুযায়ী, ৬ শতাংশ সুদে ২০২৯ সাল পর্যন্ত এফডিআর নবায়ন করতে বাধ্য হয় রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা করপোরেশন।
পর্যায়ক্রমে সাত বছরের মধ্যে জীবন বীমার এফডিআর অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব দেয় পদ্মা ব্যাংক।
২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদে পদ্মা ব্যাংকে ৫৩ কোটি টাকা এফডিআর রাখে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। এ প্রতিষ্ঠানটিও বাধ্য হয়ে পদ্মা ব্যাংকের প্রস্তাব অনুযায়ী, ধাপে ধাপে পরিশোধের শর্তে ২০২৯ সাল পর্যন্ত এফডিআর নবায়ন করেছে।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনেরও (বিটিআরসি) ২৫ কোটি টাকার এফডিআর আটকে আছে পদ্মা ব্যাংকে।
ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি
যাত্রা শুরু করার তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আর্থিক অনিয়মের জন্য আলোচনায় আসে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ব্যাংকটি থেকে ৩হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ অনিয়মের মাধ্যমে সরিয়ে নেওয়া হয়, যার বড় অংশ এখন খেলাপি।
এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন বোর্ড চেয়ারম্যান ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মুহিউদ্দিন খান আলমগীর ও মো. মাহাবুবুল হক চিস্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্ত দুজন ২০১৭ সালের নভেম্বরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
সরকার ২০১৮ সালে ব্যাংকটিকে পুনরুদ্ধারে তৎপর হয় এবং সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) থেকে ৭১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাংকটির ৬০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়।
তবে, বিনিয়োগের পর থেকে ব্যাংকটি ক্রমাগত লোকসান করায় রাষ্ট্রায়ত্ত এসব প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগের বিপরীতে কোন লভ্যাংশ পায়নি। উলটো এসব অর্থের বিপরীতে আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ করছে বিনিয়োগকারী তিন ব্যাংক ও আইসিবি।
টিবিএসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্বীকার করেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অর্থে ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল ছিল। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে এটি করতে হয়েছিল বলে জানান তিনি।