তারল্য সংকটে ব্যাংকগুলো: সীমিত নগদ উত্তোলনের বিষয়ে হতাশ গ্রাহকরা
গত বৃহস্পতিবার ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের (এফএসআইবি) বাসাবো শাখা থেকে ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে বিস্মিত হয়েছেন অভিবাসী শ্রমিক আলাউদ্দিন। সম্প্রতি তিনি সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছেন।
লক্ষ্মীপুর জেলা সদর হাসপাতালে তার বাবার চিকিৎসাধীন। তার জন্য টাকা তুলতে আলাউদ্দিনকে ব্যাংক থেকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা অফার করা হয়।
পরিস্থিতির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে তিনি টাকার অংক বাড়ানোর জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের রাজি করানোর চেষ্টা করেন। তবে তারা তীব্র তারল্য সংকটের কথা উল্লেখ করে মাত্র ১০ হাজার টাকা দিতে রাজি হন।
এরপর আলাউদ্দিনকে খুবই হতাশ দেখাচ্ছিল। তিনি বলেন, 'আমি তাদের বলেছিলাম, এ টাকা আমার বাবার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন, কিন্তু তারা বলেছেন, ব্যাংক নগদ প্রবাহের সংকট রয়েছে। এর বেশি দিতে পারবেন না।এই খরচ আমি কীভাবে মেটাব?'
এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। দেশজুড়ে একই ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে ইউএনবি জানতে পারে, টাঙ্গাইলে এফএসআইবি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের শাখাই গত বুধ ও বৃহস্পতিবার গ্রাহকরা জড়ো হন। প্রত্যেকবার লেনদেনে মাত্র ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা অফার করার পরে অনেক গ্রাহক হতাশ হয়ে চলে গেছেন।
এফএসআইবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইউএনবির সঙ্গে কথা বলার সময় এই সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, ব্যাংকগুলো নজিরবিহীন তারল্য সংকটে পড়েছে, কারণ গ্রাহকরা তাদের হঠাৎ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছেন।
একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্রাহকদের ধীরে ধীরে কম পরিমাণে অর্থ উত্তোলন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এফএসআইবির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুল মান্নান চ্যালেঞ্জের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, 'জরুরি চাহিদা মেটাতে চলতি সপ্তাহে ৩০০ কোটি টাকা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এছাড়া ঘাটতি মেটাতে এফএসআইবি তাদের বিনিয়োগ থেকে ৪৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।'
মান্নান বলেন, স্বল্প মেয়াদে তারল্য নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তঃব্যাংক ঋণের নিশ্চয়তা দিয়েছিল।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সহসভাপতি মান্নান বলেন, 'ব্যাংকিং খাতের এটি একটি নিয়মিত ব্যবস্থা, যা দেশে বিগত সরকারের আমলে নানা অপব্যবহারের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।'
ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল) চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করে আর্থিক দুরবস্থার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণহীনতাকে দায়ী করেছেন। সবসময় ন্যাশনাল ব্যাংকের সুনাম ছিল, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল তদারকির কারণে এটি গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে।
এখন পদক্ষেপ নেওয়া এবং তারল্য ঘাটতি ঠিক করা তাদের দায়িত্ব বলে জানান তিনি।
এস আলম ও সিকদার গ্রুপের মতো কোম্পানিগুলো ঋণের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় ব্যাংকগুলো পঙ্গু হয়ে পড়ে। এখন আমানতকারীরা ভুগছেন।
দেশে ক্ষমতার পালাবদলের ফলে এসব ব্যক্তির অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন অথবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। ফলে ব্যাংকগুলো চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে।
সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে এবং এস আলম ও সিকদার গ্রুপের সম্পদ বিক্রির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে এসব সম্পদ বিক্রি করা হতে পারে। আমানতকারীদের টাকা যাতে সুরক্ষিত থাকে, তা নিশ্চিত করবে সরকার।
দেশের ৬১টি ব্যাংকের ১১ হাজারের বেশি শাখার অনেকগুলোই নগদ অর্থের তীব্র সংকটে ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে বাজারে অর্থপ্রবাহ কিছুটা কমেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ছাত্র বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মাধ্যমে সৃষ্ট অস্থিরতার কারণে বিষয়টিকে আরও ঘনীভূত হয়েছে। সে সময় ব্যাংকিং কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়, এর ফলে নগদ স্থানান্তরে ব্যাপক বিলম্ব এবং লেনদেনে জট তৈরি হয়।