ভালো ফলনের পরও কেন চালের দাম বাড়ছেই
কিছুদিন আগেই আমন মৌসুমের চাল বাজারে উঠেছে। সাধারণত ভরা মৌসুমে চালের দাম কমে এলেও গত এক মাসে মাঝারি ও সরু চালের দাম বেড়েছে কেজিতে অন্তত ৪ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত। শীতকালীন ফসল ছাড়া অন্য সব পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে চাপে থাকা ভোক্তারা এতে বাড়তি চাপে পড়েছেন।
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় জাতভেদে চালের দাম কেজিতে ৪ টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ সাধারণত বছরের এই সময়, যখন বোরোর পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধানের উৎস আমন ধান কাটা হয়, প্রধান প্রধান চালের দাম কমে যায় অথবা অন্তত স্থির থাকে।
আশঙ্কা করা হয়েছিল, আগস্টে বেশ কয়েকটি জেলায় ব্যাপক বন্যার ফলে আমনের উৎপাদন ব্যাপক কমে যাবে। কিন্তু সরকারি তথ্য বলছে উল্টো কথা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের দাবি, গত মৌসুমের তুলনায় চলতি বছর আমনের ফলন প্রায় ৫ লাখ টন বেশি। আমন মৌসুমের চাল ইতিমধ্যেই বাজারে পৌঁছেছে। তাহলে বাজারে কেন এত দাম বেড়েছে?
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মজুত কমে যাওয়া, স্থানীয় বাজার থেকে কম সংগ্রহ এবং আমদানি সিদ্ধান্তে বিলম্বের কারণে বাজারে কারসাজির সুযোগ তৈরি হয়েছে। মোটা, মাঝারি ও সরু—দেশের বাজারে মূলত এ তিন ক্যাটাগরির চাল পাওয়া যায়। খুচরা পর্যায়ে এসব ধানের দাম এখন কেজিতে যথাক্রমে ৫৪-৫৮ টাকা, ৬২-৬৪ টাকা ও ৮২-৮৬ টাকা।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অভ বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, গত বছরের এই সময়ে খুচরা বাজারে মোটা চাল ৫০-৫২ টাকা, মাঝারি চাল ৫২-৫৮ টাকা এবং সরু চাল ৬২-৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
মোটা চালের দাম, যা মূলত নিম্ন-আয়ের মানুষ খায়, খুব বেশি বাড়েনি। কিন্তু বাজারে মোটা চাল পাওয়া কঠিন। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, মোটা চাল সব দোকানে পাওয়া যায় না। ঢাকার কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতারা জানান, গত দেড় মাসে মিনিকেটের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি, কেজিতে ১০-১৪ টাকা।
কারওয়ান বাজারের চালের আড়তের পাইকারি বিক্রেতা মোশারফ হোসেন টিবিএসকে বলেন, '৬৬-৬৮ টাকার মিনিকেট এখন মিল থেকেই কিনে আনছি ৮০-৮২ টাকায়। এরপর আমাদের পরিবহন খরচ আছে। ব্যবসার খুব বাজে অবস্থা, ক্রেতা নেই। দাম বাড়লে আমাদের ক্রেতা থাকে না।' মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোতে এই জাতটি জনপ্রিয়। চাল কেনার পেছনে তাদের মাসিক বাজেট বেড়েছে।
কারওয়ান বাজারে চাল কিনতে আসা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মো. মহিউদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'এখন মিনিকেট ৫০ কেজির বস্তা ৪ হাজার ১০০ টাকা চাচ্ছে। কয়েকদিন আগেও ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা ছিল। সবজি ছাড়া এখন বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। চালের দামটা সহনীয় থাকলে মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তরা খেতে পারে। কিন্তু এটা তো একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।'
খাদ্যশস্যের মজুত বৃদ্ধির তাগিদ বুঝতে পেরে গত বছরের অক্টোবরে চাল আমদানির ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছিল সরকার। আশা করেছিল, আমদানি মূল্য ১৪.৫০ টাকা কমবে। কিন্তু বেসরকারি আমদানিকারকরা খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। কারণ তারা হিসাব করে দেখেছে, শুল্ক কমানোর পরও আমদানি খরচ ৬৫ টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা স্থানীয় বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি। যদিও সম্প্রতি চাল আমদানি নিয়ে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার, তবু অনেক দেরি হয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত মাত্র ২.৬৪ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ১০.৫৬ লাখ টন চাল। বিশ্লেষকরা বলছেন, আরও আগেই চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হলে চালের বাজারে এ অস্থিরতা দেখা দিত না।
আমদানির তৎপরতা শুরু করতে অনেক দেরি
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, 'এখন সরকারের পক্ষ থেকে আমদানির জন্য যে তৎপরতা চালানো হচ্ছে, তা আরও দুই-তিন মাস আগে চালানো হলে হয়তো চালের দাম বাড়ত না। কারণ এখন তো চালের ভরা মৌসুম। এখন চালের দাম বাড়ার কোনো যোৗক্তিকতা নেই। আমদানির জন্য টাইমিং একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মজুতটা খুব বেশি না হলেও এটা একটা ইন্ডিকেটর হিসেবে কাজ করে।'
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর আমন মৌসুমে চালের উৎপাদন হয়েছে ১.৭১ কোটি টন। গত বছর আমন মৌসুমে চাল উৎপাদন হয়েছিল ১.৬৬ কোটি টন। সম্প্রতি শেষ হওয়া আমন মৌসুমে বন্যায় বেশ কিছু জেলায় আমন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চালের উৎপাদন বেড়েছে বলে সরকারিভাবে দাবি করা হচ্ছে। সরকারিভাবে উৎপাদন তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'বাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক তথ্য। কিন্তু আমাদের যে উৎপাদন তথ্য দেওয়া হয়, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আমরা গবেষণা করতে গেলে এসব তথ্যের সাথে সামঞ্জস্য পাওয়া যায় না। এ কারণে উৎপাদনের তথ্য আরও গুরুত্বসহকারে তৈরি করা প্রয়োজন।'
২০২৩ সালের আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হুট করেই ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১২.৫৪ শতাংশে পৌঁছে যায়। সে সময় টানা দুটি মৌসুমের ভালো ফসলের পর সরকারি গুদামে মজুত বেশি থাকায় চালের দাম স্থিতিশীল থাকে, যা গ্রাহকদের কিছুটা স্বস্তি দেয়। চালের বিপুল মজুত সেই সময়ে এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর জন্য ভর্তুকিযুক্ত চাল প্রকল্প অব্যাহত রাখতে সহায়তা করে।
কিন্তু এ বছর তা হয়নি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমান ধান-চাল মিলিয়ে সরকারিভাবে মোট মজুত আছে ৯ লাখ টন। গত চার বছরের মধ্যে জানুয়ারি মাসের এ মজুত সর্বনিম্ন। গত বছরের জানুয়ারিতে চালের সরকারি মজুত ছিল ১৪.২১ লাখ টন।
স্থানীয় সংগ্রহও কম
সরকারিভাবে চালের মজুতের উৎস মূলত ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম এবং আমদানি। আমদানি যেমন কম হয়েছে, তেমনি ধানচাষিদের কাছ থেকেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম ক্রয় হয়েছে। এর ফলে কমে এসেছে মজুতও। সরকারের চাল সংগ্রহে ব্যর্থতা নতুন নয়; এবারও আগের ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। চলতি আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ লাখ টন। তবে গত দুই মাসে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৩.৬২ লাখ টন।
গত অর্থবছরে চাল আমদানি না করায় মজুত পরিস্থিতি তলানিতে নেমেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ধান-চাল সংগ্রহে বরাবরই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় সরকার। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা ব্যবসায়ীদের চাপে রাখে এবং হঠাৎ সরবরাহ কমার ধাক্কা ঠেকায়। খাদ্য মজুত কমে গেলে সরকারের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ কমে আসে। অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সরকারের মজুত কমে যাওয়া চালের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে। 'কারণ এর আগেও আমরা দেখেছি সরকারি মজুত কমে এলে মিল পর্যায়ে চালের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়।'
বাজারের প্রভাবশালীরা দাম বাড়াচ্ছে?
ভোক্তা অধিকার কর্মীরা মনে করেন, চালের দাম বাড়ার পেছনে বাজারের প্রভাবশালীদেরও ভূমিকা রয়েছে। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, চালের দাম বাড়লে মিলাররা ও কর্পোরেট গ্রুপগুলো একে অপরকে দোষারোপ করে। অথচ দুই পক্ষই বাড়তি দামে বিক্রি করে। তিনি আরও বলেন, 'সরকার চালের বাজারে মনিটরিং করছে না। এ কারণে তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে।'
নাজের সতর্ক করে বলেন, 'এবার আমন মৌসুমেই চালের দাম হু হু করে বাড়ছে। সামনে রমজান। বোরো মৌসুমের চাল আসবে আগামী মে-জুনে। সরকার যদি পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে কিন্তু মে-জুন পর্যন্ত চালের দাম আরও বাড়বে। সরকারকে চাল আমদানি করে সরকারি বিতরণ বাড়াতে হবে।'