এইচএস কোডের অস্পষ্টতায় ব্যবসায়ীদের বিড়ম্বনা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হারমোনাইজড সিস্টেম (এইচএস) কোডের তালিকার বাইরে থাকা নতুন ধরনের কাঁচামাল আমদানিতে দেখা দিয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। ফলে তালিকায় নতুন কাঁচামাল অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন নিয়ে রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের ঘুরে ঘুরে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
নতুন কাঁচামালের এইচএস কোড ভুক্তিতে সাত দিন লাগার কথা থাকলেও, কোনো ক্ষেত্রে লেগেছে দুই মাস বাড়তি সময়।
তার ওপর আবার বন্ড সুবিধাকে কাজে লাগানো অসাধু ব্যবসায়ীদের কথা মাথায় রেখে কঠোর অবস্থানে এনবিআর কর্মকর্তারা। ফলে যাদের প্রকৃত প্রয়োজন তাদের কাঁচামালের চালান ছাড় করতে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।
তারা আমদানি করা কাঁচামালের চালানের এইচএস কোডে কোনো অসামঞ্জস্য থাকলে ছাড় দেন না। সঙ্গেসঙ্গেই শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিলের পাশাপাশি চালানের ওপর অন্য এইচএস কোডের অধীনে নিয়মিত শুল্কারোপ করেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ফতুল্লাহ অ্যাপারেলসের ঘটনা। দুই সপ্তাহ আগে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে ফেব্রিক লেইস আমদানি করে নারায়ণগঞ্জের প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু, বিমান বন্দর থেকে পণ্য ছাড় করতে 'বাড়তি খরচ' (ঘুষ) দিতে বাধ্য হয়। কারণ আমদানি করা লেইস বা ফিতার প্রস্থ এইচএস কোডে উল্লেখিত পরিমাণের চেয়ে সামান্য বেশি হওয়ায় বেঁকে বসেন কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
ফতুল্লাহ অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলে শামীম এহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, "সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে ৭০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ওই এক্সেসরিজ ছাড় করিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছি।"
অভিযোগ রয়েছে যে, নতুন পণ্যের জন্য এইচএস কোড ব্যবহারের অনুমতি পাওয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এড়াতে, রপ্তানিকারকদের প্রায়ই নাজেহাল হতে হয়, তাই ঝামেলা এড়াতে তারা ঘুষ দিতেই বাধ্য হন।
নাম না প্রকাশের শর্তে চট্টগ্রামের একটি পোশাক কারখানার জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা জানান, বন্ড লাইসেন্সে প্রতিটি এইচএস কোড যুক্ত করতে আড়াই থেকে ৬ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়।
বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক পণ্য শ্রেণিকরণে এইচএস কোড একটি বহুল প্রচলিত ব্যবস্থা। এর ভিত্তিতে পণ্য চিহ্নিতকরণ ও সে অনুযায়ী শুল্ক মূল্যায়ন করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। প্রায় পাঁচ হাজার গ্রুপে পণ্য শ্রেণিবদ্ধ করার জন্য এটি তৈরি করে ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশন। বিশ্বব্যাপী ২০০টিরও বেশি দেশ এ ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োগ করছে।
এদিকে শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রমাগত পরিবর্তনশীল বাজারের কারণেই তাদের নতুন ধরনের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়, যা এনবিআর-এর সামঞ্জস্যপূর্ণ এইচএস কোডের তালিকায় নেই।
তারা বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ কর্তৃক ইস্যুকৃত ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন সার্টিফিকেটে পণ্যের এইচএস কোড উল্লেখ থাকলে কোনো ব্যাংক গ্যারান্টি বা শুল্ক ছাড়াই আমদানি করা কাঁচামাল ছাড়করণের দাবি জানান।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজিম টিবিএস'কে বলেন, "ছিদ্রান্বেষী আচরণের মাধ্যমে ব্যাঘাত ঘটানো হলে আমরা এই লক্ষ্যপূরণ (নতুন কাঁচামাল আমদানি) করতে পারব না। এইচএস কোডের ঝামেলা মেটাতে গিয়ে প্রায়ই আমরা রপ্তানির লিড টাইম হারাই, যেকারণে এক পর্যায়ে অর্ডারও বাতিল করে বিদেশি ক্রেতারা। আমরা চাই ব্যবসার পরিবেশ সহজ করা হোক।"
চার বছর আগে ফ্রান্সের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কালার পেন্সিলসহ ১ লাখ ৮০ হাজার পিস বাচ্চাদের টি-শার্টের অর্ডার আসলেও তা একই কারণে নিতে পারেনি ফতুল্লাহ অ্যাপারেলস।
ফজলে শামীম এহসান বলেন, "টি-শার্টগুলি ছিল বাচ্চাদের জন্য। ক্রেতা চেয়েছিলেন প্রতিটি শার্টে যেন তিনটি রঙের পেন্সিল থাকে। কিন্তু রঙ পেন্সিল আমার বন্ড লাইসেন্সের এইচএস কোডে অন্তর্ভুক্ত না থাকায় আমাকে অর্ডারটি বাতিল করতে হয়। তালিকায় উঠাতে অনেক সময় লাগত, ফলে আমি অর্ডারটি মিস করি।"
এইচএস কোড অনুমোদনে বহু অপষ্টতা রয়ে যাওয়ায় অনেক কোম্পানি এইচএস কোড সংক্রান্ত জটিলতার কারণে কাঁচামাল আমদানিতে এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, মোট সাড়ে ৮ হাজার বন্ড লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ের ৫০ শতাংশের বেশি নতুন কাঁচামালে এইচএস কোড পেতে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অথচ পরিবর্তিত বিশ্ববাজার পরিস্থিতির কারণে এসব চালান তাদের সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজন হয়।
সম্প্রতি এনবিআর- এর সঙ্গে এক বৈঠকে বন্ড লাইসেন্স ইস্যু করাসহ নিষিদ্ধ পণ্য ছাড়া অন্য সকল পণ্যের এইচএস কোড প্রদানের প্রস্তাব দেয় বিজিএমইএ। এইচএস কোড সংক্রান্ত হয়রানি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের পাশাপাশি অন্য খাতও কথা বলে আসছে। তাই রপ্তানিকারক ও তাদের সংশ্লিষ্ট সমিতিগুলোর আবেদনের প্রেক্ষিতেই এ প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এদিকে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) ৯২২টি যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের এইসএস কোড ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গত বছরের অক্টোবরে এনবিআরকে অনুরোধ করে চিঠি পাঠালেও এখন পর্যন্ত তা অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
অথচ, বেপজার আওতাধীন কারখানাগুলো বন্ড সুবিধা ভোগ করে।
বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "১০ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে ক্রেতাদের রুচি ও চাহিদায় পরিবর্তন এসেছে, পরিবর্তন এসেছে ফ্যাশনেও। এসব কারণে নতুন নতুন কাঁচামাল ও এক্সেসরিজ যুক্ত হয় রপ্তানির উদ্দেশ্যে আনা কাঁচামালের আমদানি তালিকায়। কিন্তু এইচএস কোডে এসব কাঁচামাল সংযোজন করার সময় অনুমোদন পাওয়া কঠিন হয়।"
"আবার বন্দরে আটকে দিয়ে পরীক্ষার নামে সময়ক্ষেপণ করে ক্ষেত্রবিশেষে দুই মাসও আটকে রাখা হচ্ছে। এসব কারণে উৎপাদন বিলম্বিত হওয়ায় শিপমেন্ট মিস করে বিপুল আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়ে বিমানে পাঠাতে হয়। ক্রেতাকে মূল্যছাড় দিতে হয়, এমনকি কার্যাদেশও বাতিল হচ্ছে" – বলেন তিনি।
অনুমোদনের শিথিলতায় এইচএস কোড অপব্যবহারের ঝুঁকি বাড়বে:
কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা যদি চাহিদা অনুযায়ী এইচএস কোড ব্যবহারের জন্য পাইকারি অনুমোদন দিতে থাকেন তাদের এর অপব্যবহার হবে। যেমন শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হতে পারে।
ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান বলেন, "কেউ যদি ভুল এইচএস কোডে পণ্য আমদানি করে বলেন, সেটি সঠিক কিংবা তা মেনে নিতে হবে; কাস্টমস বিভাগ তা পারে না। এমন চালান আটকে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।"
তার মতে, কোন কর্মকর্তা এইচএস কোড নির্ধারণে ভুল করলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তা পরীক্ষা করে বিশ্লেষণ করতে হয়।
"ঢাকা কাস্টম হাউজে বর্তমানে প্রায় ৯০ শতাংশ বিল অব এন্ট্রি (পণ্য চালান) প্রথম ২৪ ঘন্টায় শুল্কায়ন হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে গোয়েন্দা তথ্য বা অন্য কোন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অভিযোগ থাকলে সেক্ষেত্রে দেরি হতে পারে"- বলে উল্লেখ করেন ফয়জুর রহমান।
তবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, "শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের হাতে বিপুল ক্ষমতা থাকাও এইচএস কোড সংক্রান্ত সমস্যার পেছনে দায়ী।"
রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য আলী আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই সমস্যা খুব সহজে সমাধান হওয়ার রাস্তা নেই। তবে শুল্ক বিভাগের কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় করা হলে, আইনি কাঠামো আরো সহজীকরণ এবং কর্মকর্তাদের সততা ও সহযোাগিতার মনোভাব তৈরি হলে এমন জটিলতা অনেক কমানো সম্ভব।"
তিনি বলেন, "নিচের স্তরের কর্মকর্তাতের মধ্যে দুর্নীতির মনোভাব বেশি।"
অবশ্য এইচএস কোড অনুমোদন সংক্রান্ত ফাইল আটকে রাখা ঠেকাতে সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। একটি আবেদনের ফাইল কোন কর্মকর্তা কত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করবে, সে বিষয়ে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।