কৃষকের বাজার, যেখানে নেই কোনো মধ্যস্বত্বভোগী
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার মূলনা ইউনিয়নের মিরাসার চাষি বাজার। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালে ৩২ শতাংশ জমির ওপর যাত্রা শুরু হয় এই বাজারের। কোনো প্রকার মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই কৃষক তার উৎপাদিত ফসল সরাসরি বিক্রি করছেন পাইকারদের কাছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্য ক্রয় করতে প্রতিদিন কৃষকের এই বাজারটিতে ভিড় জামাচ্ছেন হাজারও পাইকার আর সবজি ব্যবসায়ীরা। সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের ফসল ও সবজি কেনাবেচা হয় কৃষকের এই বাজারে।
বাজারটির পরিধি বেড়ে এখন দুই একর ছাড়িয়েছে। শরীয়তপুর-ঢাকা সড়কের পাশে অবস্থিত কৃষকের এই বাজারে বর্তমানে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত ১২০টি বিক্রয়ের দোকান রয়েছে। প্রাথমিক ভাবে ১২৫ জন কৃষক সমিতি করে তাদের পণ্য বিক্রয়ের জন্য বাজারটি চালু করলেও এখন স্থানীয় সকল কৃষক এই বাজার ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন।
মিরাসার চাষী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, শত শত কৃষক তার পণ্য বিক্রিতে ব্যস্ত। কৃষক আর পাইকারের ভিড়ে বাজারে পা রাখার জায়গা নেই। ঢাকা, চাঁদপুর, বরিশাল, বরগুনা, খুলনা, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শত শত পাইকার তাদের চাহিদা মত পণ্য ক্রয় করে ট্রাকে ওঠাতে ব্যস্ত। অনেকেই আবার বাজার ঘুরে
প্রয়োজনীয় সবজি ক্রয় বা পছন্দ করছেন। বাজারের প্রবেশ মুখে রয়েছে শীতকালীন সবজির দোকান। আর ভেতরের দিকে বা শেষের অংশে রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, কালোজিরা, ধনিয়াসহ বিভিন্ন শষ্যের দোকান। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর শীতকালীন সবজির দাম বেশ চড়া। বর্তমানে এই বাজারে প্রতি কেজি ফুলকপি ২৫ থেকে ৩০, করোলা ৪২, বেগুন ২৮ থেকে ৩০, বাঁধাকপি ১৮ থেকে ২০, লাউ আকার ভেদে ৫০ থেকে ৭০ টাকা দরে এবং পেঁয়াজ ১৮ থেকে ২০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।
ট্রাকে সবজি বোঝাই করে বাজার থেকে বের হওয়ার সময় কথা হয় বরিশালের পাইকার আমজাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, "শরীয়তপুরের এই চাষী বাজারে টাটকা সবজি পাওয়া যায়। তাছাড়া বরিশাল থেকে সড়ক পথে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় এখান থেকে সবজি নিতে অনেক পাইকাররা আসে।"
ঢাকা থেকে আসা ব্যবসায়ী ইমরুল হাসান জানান, "পণ্য ক্রয়ে বিড়ম্বনা কম তাই এই বাজার থেকে পণ্য ক্রয়ে স্বাচ্ছন্দ পাই। প্রতি ট্রিপে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার পণ্য ক্রয় করি। সড়কের পাশেই বাজার তাই পরিবহনেও নেই কোনো ঝামেলা। চাঁদাবাজ ও পকেটমার কোনো উৎপাত নেই। তবে, বাজারের কাছে ব্যাংকিং সুবিধা জরুরী। তাহলে লেনদেন আরও সহজ হতো।"
মাদারীপুরের শিবচর থেকে আসা সবজি ব্যবসায়ী জহিরুল আকন বলেন, "জাজিরার চাষী বাজার থেকে সব ধরনের সবজি ক্রয় করা যায়। এই অঞ্চলের মধ্যে তুলনামূলক কম দামে ভালো সবজি ক্রয় করতে এখানে এসেছি। সব মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকার সবজি ক্রয় করেছি। আড়তে ফিরে স্থানীয় বাজারে এই সবজি বিক্রি করব।"
জাজিরার কাজিরহাট এলাকার কৃষক আব্দুর রাজ্জাক জানান, এ বছরের বন্যা ও অসময়ে বৃষ্টিপাতের ফলে ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে সবজির দাম কিছুটা বেশি হওয়ায় ক্ষতি পুষিয়ে তারা লাভবান হচ্ছেন। মিরাসার চাষী বাজারে ফসল বিক্রি করতে কোন আড়ৎদারি বা টোল দিতে হয় না।
রাজ্জাক বলেন, "আমরা আমাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি এখান থেকে পাইকারদের কাছে বিক্রয় করতে পারি। নিজেরাই নিজেদের পণ্যে দরদাম করে বিক্রি করি। কোন প্রকার দালাল বা ফড়িয়া নেই। ফসল বিক্রি করে আমরা লাভবান হচ্ছি।"
মিরাসার চাষী বাজার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি প্রিন্স খান জানান, সমিতির সদস্যা সংখ্যা এখন ২৬০ জন। সদস্যরা ২৫ টাকা করে মাসিক চাঁদা দিয়ে থাকেন। ওই টাকা সমিতির ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয়। কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে ভবিষ্যতে ওই টাকা আয়মূলক কাজে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এছাড়া বাজার পরিচালনার জন্য বাজার কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি কৃষকের সুযোগ সুবিধা, বাজারের উন্নয়নসহ আরও বিভিন্ন বিষয় দেখাশোনা করে। পণ্য বিক্রির সময়, প্রতি মণ পণ্যের জন্য পাইকারদের কাছ থেকে ৩ টাকা নেয়া হয়। সেই টাকা দিয়ে বাজারের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, বাজার উন্নয়নের কাজ ও বিভিন্ন ব্যয় নির্বাহ করা হয়ে থাকে।
মিরাসার চাষী বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি আব্দুল জলিল মাদবর বলেন, "মিরাসা চাষী বাজারটি সমবায় সমিতির মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। বাজারে ব্যবহৃত জমি বিভিন্ন মালিকের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর ৫ লাখ টাকা ইজারা বাবদ জমির মালিকদের দিতে হয়।"
এছাড়া, কৃষকের পণ্য সামগ্রী বিক্রি করতে সমিতির পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তাও দেওয়া হয় বলে জানান আব্দুল জলিল।