উচ্চফলনশীল ভেনামি চিংড়ি চাষে নেই সবুজসংকেত, ক্রমশ কমছে রপ্তানি
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বিএফআরআই) তত্ত্বাবধানে উচ্চফলনশীল ভেনামি জাতের চিংড়ি চাষের জন্য নতুন তিনটি প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে এক বছর সময় দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও পোনা উৎপাদনে আগ্রহীদের হ্যাচারিগুলোর বিষয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি অধিদপ্তর।
এই টানাপোড়নে চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। উদ্যোক্তারা দ্রুত ভেনামি চাষ সম্প্রসারণ করতে চাইলেও সরকারের তরফ থেকে আরোপিত নিয়ন্ত্রিত চাষ পদ্ধতি ভেনামির দ্রুত সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দ্রুত আমরা উচ্চফলনশীল ভেনামির বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে না পারলে আন্তর্জাতিক বাজারেও পিছিয়ে থাকবো। এজন্য আমাদেরকে ভেনামি উৎপাদনের পাশাপাশি দ্রুত ভেনামির পোনা উৎপাদনেরও অনুমতি দেয়া দরকার।"
বিএফএফইএ বলছে, ৩২ বিলিয়ন ডলারের চিংড়ির আন্তর্জাতিক বাজারের ৮০ শতাংশ এখন ভেনামির দখলে। দামে সস্তা হওয়ার কারণেই এর জনপ্রিয়তা দ্রুত বেড়েছে। অথচ বাংলাদেশ এখনো ভেনামির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে না পারায় প্রসেসিংয়ে কাঁচামালের সংকটে ভুগছে। গত ১০ বছরে কাঁচামালের অভাবে অন্তত ৩০টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আরও ১০-১৫টি বন্ধের পথে।
রপ্তানিকারকদের সংগঠনটির তথ্য বলছে, বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনুমোদিত ৭৬টি চিংড়ি প্রসেসিং প্ল্যান্ট রয়েছে। এদের চার লাখ টন প্রসেসিং সক্ষমতা থাকলেও দেশে চিংড়ির উৎপাদনই আড়াই লাখ টনের কিছু বেশি। যেখান থেকে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে মাত্র প্রায় ৭৭ হাজার টন। শুধুমাত্র কাঁচামালের অভাবেই ৮০.৭৫ শতাংশ সক্ষমতা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।
এদিকে ভেনামির পরীক্ষামূলক চাষের প্রথম দফায় অনুমতি পাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভেনামির পরীক্ষামূলক উৎপাদন সম্পন্ন করেছে এমইউ সি ফুড। প্রতিষ্ঠানটি ভেনামি চাষের জন্য থাইল্যান্ড থেকে ১০ লাখ ৮ হাজার পিস পোনা আমদানি করে। তাদের খুলনার পাইকগাছার চাষের পুকুর পর্যন্ত পৌঁছাতেই প্রায় ২৪ শতাংশ পোনা মরে যায়। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হলে এত বেশি পোনা নষ্ট হতো না বলে জানায় উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানটি।
ফলে উদ্যোক্তারা দাবি করেছেন, ভেনামির চাষ দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য পোনা উৎপাদনের অনুমতি দেওয়ার। যেহেতু ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষামূলক উৎপাদনের জন্য অনুমতি দেয়া হচ্ছে সেজন্য একইসঙ্গে হ্যাচারির মাধ্যমে পোনা উৎপাদনেও যাওয়া উচিত।
মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আতিয়ার রহমান টিবিএসকে বলেন, "আমরা ভেনামির উৎপাদনের জন্য ধারাবাহিকভাবে অনুমতি দেয়া শুরু করেছি। তবে পোনা উৎপাদনে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেও সেগুলো আরও যাচাই-বাছাইয়ের দরকার।"
তিনি বলেন, যাচাই-বাছাই শেষ হলে টেকনিক্যাল কমিটিতে রিপোর্ট পাঠানো হবে। তারাই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এর জন্য আরও সময়ের দরকার।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, প্রথম দফায় কক্সবাজারে অ্যাগ্রো বিজনেস এন্টারপ্রাইজ ও বেসরকারি এনজিও সুশীলনকে ভেনামির পরীক্ষামূলক উৎপাদনের অনুমতি দেয়া হয়। এর মধ্যে সুশীলন এমইউ সি ফুডের সঙ্গে যৌথভাবে এর উৎপাদন করে। দ্বিতীয় দফায় এমইউ সি ফুড, ফাহিম সি ফুড লিমিটেড ও গ্রোটেক অ্যাকুয়াকালচার লিমিটেডকে অনুমতি দেয়া হয়েছে।
এমইউ সি ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস টিবিএসকে বলেন, "আমরা অনেক দিন ধরেই কাঁচামালের সংকটে চাইলেও রপ্তানি বাড়াতে পারছি না। এর জন্য দ্রুত বাণিজ্যিক চাষের অনুমতি দেয়া দরকার। একই সঙ্গে পোনা উৎপাদনের অনুমতিও প্রয়োজন, তা না হলেও আমাদেরকে এর জন্য বিদেশের উপর নির্ভর করতে হবে।"
উল্লেখ্য, এমইউ সি ফুড খুলনার পাইকগাছায় ফিএফআরআইয়ের চারটি নোনা পানির কেন্দ্রে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ভেনামির চাষ করে। মোট ১.৫৬ হেক্টর জমিতে ১৩৮৮৬ কেজি চিৎড়ি উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৯০ দিনে। যেখানে হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৮৯০১ কেজি।
বিএফএফইএ ও মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ভেনামির ফলন পাওয়া যায় ৯০-১০০ দিনের মধ্যে। যেখানে বাগদা চিংড়ির ফলন পেতে হলে দরকার হয় ১৪০-১৬০ দিন। ভেনামি উচ্চফলনশীল বলে চায়না, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্ডিয়া, মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে এটির চাষ হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করছে ভারত। অথচ বাংলাদেশ এখনো এর বাণিজ্যিক উৎপাদনই শুরু করতে পারছে না।
প্রসেসর প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, আমাদের তিন লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ির চাষ হয়। অন্যদিকে ভারত এর চেয়েও কম জমিতে চাষ করে ৮ লাখ টন চিংড়ি উৎপাদন করছে। তাদের উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ৯-১৫ হাজার কেজি। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ছিটকে পড়ছে।
ভেনামি চাষের জন্য সয়েল টেস্ট, পুকুর খনন, বিদ্যুতায়ন, পরীক্ষাগার এবং জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ দরকার। এর বাইরে প্রয়োজন কোয়ালিটি ফিড। এর জন্য ভালো বিনিয়োগ দরকার। উৎপাদনকারীরা ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করতেও আগ্রহী, কারণ তারা চান দ্রুত এর বাণিজ্যিক উৎপাদন।
এমইউ সি ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস জানান, তারা উৎপাদনের জন্য ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। যারা কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। পাশাপাশি এর জন্য খাবারগুলোও ভারত থেকে আমদানি করা হয়।
রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমছে
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে বাংলাদেশ মোট ৪৫৫ মিলিয়ন ডলারের ৪১,২৩৬ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি করে। এরপর থেকেই বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে চিংড়ির বাজার হারাতে থাকে। সেই সাথে উৎপাদনও ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে চিংড়ি রপ্তানি ৩৪ শতাংশ কমে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হয়েছে ৩৬১ মিলিয়ন ডলার। সে বছরে ২৯ হাজার ৫৪৩ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল।
২০১৯-২০ সালে আরও কমে চিংড়ি রপ্তানি দাঁড়ায় ৩৩২ মিলিয়নে এবং ২০২০-২১ বছরে গিয়ে আরও দুই মিলিয়নের রপ্তানি হারায়। তবে ২০২১-২২ এর প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি হয়েছে ২৬৯ মিলিয়ন ডলার।