বন্ড সুবিধার বৈষম্য দূর করার দাবি নন-আরএমজি রপ্তানিকারকদের
বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স পাওয়ার জটিল প্রক্রিয়া এবং এই সুবিধাপ্রাপ্তদের প্রতি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে নন-আরএমজি রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এ কারণে নন-আরএমজি খাত পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে বিকশিত হতে পারছে না বলে অভিযোগ করছে তারা।
নন-আরএমজি শিল্প খাতের শীর্ষস্থানীয়দের অভিযোগ, তারা আরএমজি খাতের সমান সুবিধা পাচ্ছেন না। এর ফলে তারা রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যার জেরে রপ্তানিজগতে প্রতিযোগিতা-সক্ষমতায় দেশ আরও পিছিয়ে পড়ছে।
বন্ড লাইসেন্সবিহীন অনেক রপ্তানিকারককে কাঁচামাল ও বিভিন্ন অ্যকসেসরিজ আমদানিতে ৩০-৩৫ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু শুল্কের অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য তাদের জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রায় ২২ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয় এ অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য। কেবল কিছু বড় কোম্পানিই এ প্রক্রিয়ায় শুল্কের অর্থ ফেরত পেতে পারে।
দেশে বর্তমানে তৈরি পোশাক কারখানা, প্লাস্টিক, চামড়া ও গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজ এবং কেমিক্যাল খাত মিলিয়ে অ্যাকটিভ বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৪ হাজার। এই প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করে।
কিন্তু পোশাক খাতের কারখানাগুলো পায়, এমন অন্তত ১০ ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত আরএমজির বাইরের বন্ড লাইসেন্সধারী অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে আরএমজি-বহির্ভূত এসব প্রতিষ্ঠান বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুবিধা সব খাতের জন্যই নিশ্চিত করা উচিত, এবং এসব সুবিধা শুধু আরএমজির অনুকূল না হয়ে সবার জন্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
উদাহরণ হিসেবে ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের কথাই ধরা যাক। ২৪ বছর ধরে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাটজাত পণ্য রপ্তানি করছে প্রতিষ্ঠানটি। অথচ বছরে প্রায় ৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানিকারক এই প্রতিষ্ঠান বন্ড লাইসেন্স সুবিধা পায় না। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে বিভিন্ন অ্যকসেসরিজ অন্তত ৩০ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে আমদানি করতে হয়।
ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা বন্ড লাইসেন্সের সুবিধা না পাওয়ায় আমদানি করা অ্যাকসেসরিজ কিংবা কেমিক্যালে শুল্কমুক্ত সুবিধা নিতে পারি না। এ কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে রয়েছি। এ সুবিধা পেলে আমার প্রতিষ্ঠান এতদিনে বর্তমানের চেয়ে চারগুণ বেশি রপ্তানি করতে পারত।'
রপ্তানির কাঁচামাল বা কেমিক্যাল শুল্ক ও ভ্যাট পরিশোধ করে কেনা হলে এনবিআরের ডিউটি এক্সেম্পশন অ্যান্ড ড্রব্যাক অফিস (ডিইডিও) থেকে ওই শুল্ক ফেরত পেতে পারেন বন্ড সুবিধার বাইরে থাকা রপ্তানিকারকরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি রপ্তানি সংগঠনের সূত্র জানায়, শুল্কের অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য নন-বন্ডেড রপ্তানিকারকদের যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, তা সম্পন্ন করতে অনেকসময়ই এক বছর বা তারও বেশি সময় লেগে যায়।
তিনি জানিয়েছেন, যে অর্থ ফেরত পাওয়া যায় তার অর্ধেকের বেশিই ভ্যাট সার্টিফিকেট সংগ্রহ থেকে শুরু করে কারখানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিদর্শন কর্মকর্তা ও ব্যাংকে রপ্তানির হিসাব জমা দেওয়া এবং কাজে বিলম্ব এড়াতে স্পিড মানি দিতেই খরচ হয়ে যায়।
ওই সংগঠনের সভাপতি আরও জানান, এ প্রক্রিয়া এখানেই শেষ হয় না, কাগজপত্রের আরও অনেক কাজই বাকি থাকে।
এর ফলে অপেক্ষাকৃত ছোট রপ্তানিকারকরা শুল্কের অর্থ ফেরত আনার ঝামেলায় যান না বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'আমাদের সেক্টরের রপ্তানিকারকরাও বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার বাইরে। যেসব শর্ত ও জটিলতা আছে, তা মেনে ওই অর্থ আদায় করা আমাদের বেশিরভাগের পক্ষেই সম্ভব হয় না।'
বৈষম্য
অন্যদিকে একই বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও আরএমজি খাতের সমান সুবিধা পাচ্ছে না নন-আরএমজি রপ্তানিকারকেরা। ফলে এ খাতগুলোর রপ্তানি সম্ভাবনার বেশিরভাগই কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বৈষম্যের শুরু কাঁচামালের এনটাইটেলমেন্ট পাওয়া থেকেই। নন-আরমএজি খাতকে এনটাইটেলমেন্টের জন্য আবেদন করতে হয় কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে, যাতে অনেক সময় ব্যয় হয়। অথচ পোশাক রপ্তানিকারকেরা এই এনটাইটেলমেন্ট সহজেই পেতে পারে পোশাক খাতের দুটি সংগঠন, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর কাছ থেকে।
এছাড়া আরএমজি কারখানাগুলোকে লাইসেন্স নবায়নের জন্য মাত্র ৫ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়, যেখানে অন্য কোম্পানিগুলোকে দিতে হয় ১১ ধরনের কাগজপত্র।
আমদানিকৃত কাঁচামাল ওয়্যারহাউসে রাখার জন্য আরএমজি কারখানাগুলো ২৪ মাস সময় পায়, এবং পরবর্তীতে বিশেষ প্রয়োজনে তা আরো ৬ মাস পর্যন্ত বাড়ানো যায়। অন্য কোম্পানিগুলো এ সুবিধা পায় মাত্র তিন মাসের জন্য। তাছাড়া আরএমজি কোম্পানিগুলোর জন্য সাবকন্ট্রাকটিং কাজ করার সুযোগ রয়েছে, যা অন্য খাতের জন্য নেই।
জাহাজ ছাড়ার আগে রপ্তানি পণ্য চালানের জন্য আরএমজি কোম্পানিগুলোর কাট-অফ টাইম ২৪ ঘণ্টা, কিন্তু অন্যান্য খাতের জন্য এ সময় ৯৬ ঘণ্টা।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, 'রপ্তানিকারকদের সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য রাখা উচিত নয়। এটি রপ্তানি পণ্য বহুমূখীকরণের ক্ষেত্রে বাধা।'
তিনি বলেন, বন্ড লাইসেন্স নেওয়ার জন্য যেসব শর্ত দেওয়া রয়েছে, তা পরিপালন করে অপেক্ষাকৃত ছোট রপ্তানিকারকরা লাইসেন্স নিতে পারবে না। ক্ষেত্রে সেন্ট্রাল বন্ডেড ওয়্যারহাউস ব্যবস্থা চালু করে ছোট আকারের রপ্তানিকারকদের রপ্তানি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।
অবশ্য এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের একজন কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে জানান, নন-আরএমজি খাতের যেসব প্রতিষ্ঠানকে বন্ড সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তাদের ৬০ শতাংশই ব্যবসায় টিকতে পারেনি। 'কেন পারেনি, তা আগে আইডেন্টিফাই হওয়া দরকার। হাইটেক পার্কে ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিকে এ সুবিধা দেওয়া হলেও তারা টিকতে পারেনি।'
সমান সুবিধা দিলে বাড়তে পারে রপ্তানি
বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন-এর (আইএফসি) এক সাম্প্রতিক গবেষণায় অনুসারে, অন্যান্য খাতগুলোও আরএমজি খাতের মতো সমান বন্ড সুবিধা পেলে বাংলাদেশের রপ্তানি ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়ত।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে নন-আরমএজি খাতকে আরএমজির সমান বন্ড সুবিধা দেওয়ার প্রসঙ্গটি তোলা হয়।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টউইগ শেফার গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফরকালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে বৈঠককালে এর গুরুত্ব তুলে ধরেন।
পরবর্তীতে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর এনবিআর চেয়ারম্যানকে পাঠানো এক চিঠিতে তিনি বলেন, ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হবে বাংলাদেশের। কাজেই রপ্তানি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য একটি সুস্পষ্ট কৌশল জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডোর বাস্তবায়ন এবং আরএমজি-বহির্ভূত খাতগুলো যেন বন্ডেড ওয়্যারহাউস কর্মসূচির সুফল পেতে পারে, সেজন্য নীতি পরিবর্তন নিয়ে এনবিআর ও বিশ্বব্যাংকের টিমগুলো আলোচনা চালিয়ে যাবে।
এদিকে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, 'বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে। এই মুহূর্তে যা দেওয়া হয়েছে, তা সামাল দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ কারণে নতুন কোনো খাতকে বন্ড লাইসেন্স সিবিধা দিতে সাবধানতা অবলম্বন করি।'
সমান সুবিধা নিশ্চিতের আহ্বান
আরএমজির বাইরে বন্ড লাইসেন্সপ্রাপ্ত অন্যান্য খাতের উদ্যোক্তারাও তাদেরকে আরএমজির সমান সুবিধা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষের প্রতি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন মতি বলেন, 'বন্ড লাইসেন্স থাকলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমরা আরমএমজির চেয়ে সুবিধায় পিছিয়ে রয়েছি কিংবা বাড়তি শর্ত দিয়ে রাখা হয়েছে। এসব বাধা না থাকলে এ খাতের সক্ষমতা আরো বাড়ত।'
বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, 'পোশাক খাতের দুটি অ্যাসোসিয়েশন নিজেদের বন্ড লাইসেন্সধারী সদস্য কারখানাগুলোর কাঁচামালের এনটাইটেলমেন্টের জন্য ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) দিতে পারলেও আমাদের সদস্যদের তা নিতে হয় কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে।'
'প্লাস্টিক খাতের রপ্তানিকারকদের জন্য আমাদের সংগঠন ইউডি দিতে পারবে বলে ২০১৭ সালে এনবিআর আমাদের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করেনি,' যোগ করেন তিনি।