যেভাবে দস্যুমুক্ত হলো চট্টগ্রাম বন্দর
১২ ডিসেম্বর ২০২০। কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ার পশ্চিমে ১০ জনের একটি সশস্ত্র দল সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী ব্রিজওয়াটার ৮০ নামের একটি সাপ্লাই ভেসেলে উঠে পড়ে। ওই ভেসেল থেকে দুই ড্রাম হাইড্রোলিক অয়েল ও হোস পাইপ ছিনিয়ে নিয়ে যায় চক্রটি।
ঘটনাটি চট্টগ্রাম বন্দর সীমানার বাইরে ঘটলেও চট্টগ্রাম বন্দরের ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (ভিটিএমএস) মাধ্যমে কোস্ট গার্ডের সহযোগিতায় এসব মালামাল উদ্ধার করা হয়। পুলিশে দেওয়া হয় ডাকাত চক্রকে। চট্টগ্রাম বন্দরের ভিটিএমএসের কারণে সংঘবদ্ধ চক্রের দস্যুতা এভাবেই ভেস্তে যায়। এই সাফল্য আসে বন্দরের প্রায় ১৬ বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়।
রিজিয়নাল কোঅপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট অন কমব্যাটিং পাইরেসি অ্যান্ড আর্মড রবারি অ্যাগেইনস্ট শিপস ইন এশিয়া-র (রিক্যাপ) প্রতিবেদন অনুসাড়ে, এটিই চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বশেষ দস্যুতার ঘটনা।
এরপর থেকে বন্দরে সূচনা হয় নতুন যুগের। অতীতের আতঙ্কের সময় কেটে গিয়ে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়। তবে এই অবস্থায় পৌঁছানোর আগে বিস্তর কাজ করতে হয়েছে।
২০০০ সালে একটি ফিশিং বোটে লুটপাট চালিয়ে পাঁচ জেলেকে খুন করে জলদস্যুরা।
ওই বছরই শেল অয়েল কোম্পানির একটি জাহাজে একজন ইন্দোনেশিয়ান অফিসার গুলিবিদ্ধ হন। এই ঘটনার পর জাহাজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করার জন্য বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মকর্তা এবং শিপিং প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ১০ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) ২০০৬ সালের একটি প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বন্দরকে জলদস্যু আক্রমণের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক বন্দর ঘোষণা করা হয়। ওই বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে দস্যুতার ঘটনা ঘটেছিল ৪৭টি।
একের পর এক দস্যুতার ঘটনায় ওই সময়ে পৃথিবীজুড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নেতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়। এর ফলে অনিরাপদ মনে করে বিদেশি জাহাজগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে অস্বীকৃতি জানাত।
আর যেসব জাহাজ আসত, ঝুঁকির বিবেচনায় সেগুলোও নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নিত। ফলে আমদানি ও রপ্তানি খরচ পড়ত বেশি। এর প্রভাব পড়ে পণ্যবাজারে।
তবে বন্দর সীমানায় দস্যুতা কমানোর জন্য বেশ কিছু সফল পদক্ষেপ নেয় কর্তৃপক্ষ।
কোস্ট গার্ডের টহল বৃদ্ধি, ট্র্যাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করা, বহির্নোঙ্গরে অনুমোদনহীন জাহাজের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, জাহাজে ওয়াচম্যান সরবরাহ, বন্দর ইয়ার্ডে ১ হাজার ২৫০টি সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ বেশি কিছু পদক্ষেপ নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
টহল দেয়ার সীমানাও ৭ নটিক্যাল মাইল থেকে বাড়িয়ে ৬৫ নটিক্যাল মাইল করে।
২০১২ সালের জানুয়ারিতে আইএমবি ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে তাদের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জলদস্যুপ্রবণ দেশের তালিকা থেকে বাদ দেয়।
বন্দর কর্তৃপক্ষের সময়োচিত প্রচেষ্টার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর এখন শতভাগ দস্যুতামুক্ত। এর ফলে উজ্জ্বল হয়েছে দেশের ভাবমূর্তি। নিরাপত্তা পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে কমতে থাকে জাহাজের ভাড়া ও ইনস্যুরেন্সের প্রিমিয়ামও।
রিক্যাপের তথ্যানুসারে, ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে দস্যুতার ঘটনা ঘটে ১০টি। ২০১৬ সালে দস্যুতার ঘটনা একটিতে নেমে আসে। তবে ২০১৭ সালে ১১টি এবং ২০১৮ সালে ৯টি দস্যুতার ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম বন্দর শতভাগ দস্যুতামুক্ত হয় ২০১৯ সালে। এরপর থেকে এ পর্যন্ত বন্দরে মাত্র একটি দস্যুতার ঘটনা ঘটে, ২০২০ সালে।
রিক্যাপের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে সারা বিশ্বে মোট ৭৭টি দস্যুতা এবং ৫টি দস্যুতার চেষ্টার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ৪টি, মালয়েশিয়ায় ৪টি এবং মালাক্কা প্রণালি ও সিঙ্গাপুরে ৫০টি ঘটনা ঘটেছে।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে সাতটি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ৫টি ঘটনা ঘটেছে সিঙ্গাপুর প্রণালিতে এবং বাকি দুটি ঘটেছে ভারতে।
যেসব উদ্যোগে পাল্টে যায় চিত্র
২০০০ প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দর কোস্টগার্ডকে দুটি পেট্রোল বোট দেওয়া হয়। এসব পেট্রোল বোট দিয়ে বন্দর চ্যানেলে নজরদারি বাড়ায় কোস্ট গার্ড। কোনো ধরনের দস্যুতার ঘটনা ঘটলে দ্রুত উপস্থিত হতে পারত কোস্ট গার্ড। এরপর থেকে কমতে থাকে বন্দরের দস্যুতার ঘটনা।
২০১৩ সালে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সুইডেন থেকে আমদানি করা হয় ভিটিএমএস পদ্ধতি। এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর সীমানার ১০ নটিক্যাল মাইল অংশ ভিডিও মনিটরিংয়ের আওতায় চলে আসে।
মনিটরিংয়ের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের পুরো চ্যানেল ও তার আশপাশের এলাকা ঘিরে পতেঙ্গা, বন্দর ভবন, সদরঘাট, রুবি গেইট, আনোয়ারাসহ বিভিন্ন স্থানে ৪৬টি অতি-ক্ষমতাসম্পন্ন ভিডিও ক্যামেরা (আইআর) স্থাপন করা হয়।
এছাড়া ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কুতুবদিয়া, মাতারবাড়ি, সীতাকুণ্ড এলাকায় আরো ১০০টি আইআর ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগও নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই কার্যক্রম শুরু হবে।
এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডকে সুরক্ষিত রাখার জন্য বন্দরের জেটি, ইয়ার্ড, হ্যান্ডওভার ইয়ার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ অংশে ধাপে ধাপে কর্তৃপক্ষ ১ হাজার ২৫০টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '২০১৩ সাল থেকে বর্হিনোঙ্গরে জাহাজ মনিটরিং ব্যবস্থায় চালু করা হয় ভিটিএমএস। চট্টগ্রাম বন্দরে পাইরেসি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে কাজ করছে নৌ বাহিনী ও কোস্ট গার্ড। এর ফলে বিশ্বে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তি উজ্বল হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে শতভাগ পাইরেসিমুক্ত রাখতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।'
২০১৮ ও ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা জুলফিকার আজিজ বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দরকে শতভাগ দস্যুতামুক্ত করতে আমার দায়িত্বপালনকালে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সাথে সমন্বয় করেছি। এর সুফলও পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালেই প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দর শতভাগ দস্যুতামুক্ত হয়। বর্তমানেও এই ধরাবাহিকতা রয়েছে। সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার খবরে আমি আনন্দিত।'
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, 'একসময় চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি জাহাজে ডাকাতিসহ বিভিন্ন দস্যুতার ঘটনায় শিপিং এজেন্টদের বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো। বর্হিনোঙ্গরে জোরপূর্বক জাহাজে উঠে মারধর, লুটপাট, ডাকাতির ঘটনা ঘটত। তখন জাহাজে অবস্থানরত নাবিকদের বিভিন্ন নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিয়ে তৎপর থাকতে হতো। আতঙ্কিত থাকত বিদেশি নাবিকরা। এর ফলে মেরিটাইম বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ সংকট তৈরি হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে সেরকম পরিস্থিতি নেই। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় এখন সেই পরিস্থিতি বদলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দস্যুতার ঘটনা শূন্যের কোঠায়। এই অর্জন ধরে রাখার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরকে অবশ্যই আরও তৎপর হতে হবে।'
বর্তমান চ্যালেঞ্জ
চট্টগ্রাম বন্দরে ভিটিএমএস চালু হওয়ার পর সিস্টেম সম্পর্কে কারিগরি জ্ঞান না থাকায় এটি পরিচালনায় সমস্যায় পড়তে হতো বন্দর কর্তৃপক্ষকে। পরে নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও হংকং থেকে বিশেষজ্ঞ এনে বন্দরের নৌবিভাগের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্তমানে ভিটিএমএস পরিচালনায় ৫০ জন দক্ষ কর্মকর্তা রয়েছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে জাহাজ পৌঁছালে প্রতিটি জাহাজে ৬ জন করে ওয়াচম্যান পাঠায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
তবে বাড়তি খরচের অজুহত দেখিয়ে অনেক জাহাজেই ওয়াচম্যান নিতে অস্বীকৃতি জানায় শিপিং এজেন্টরা। বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে ওয়াচম্যান বাধ্যতামূলক করা হলেও বিভিন্ন অজুহাতে এজেন্টরা ওয়াচম্যান ফিরিয়ে দেয়। চট্টগ্রাম বন্দরকে শতভাগ সদ্যুতামুক্ত রাখতে এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক সাহেদ সরওয়ার বলেন, '৬ জন ওয়াচম্যানের পেছনে প্রতিদিন ৩ হাজার ৬০০ টাকা গুনতে হয়। একটি বাল্ক ক্যারিয়ার পণ্য খালাস করতে অনেকসময় ১০ দিন বন্দরে অবস্থান করে। এক্ষেত্রে একটি জাহাজকে এই খাতে ৩৬ হাজার টাকা গুনতে হয়। তাছাড়া ওয়াচম্যানদের জাহাজে খাবার এবং থাকারও ব্যবস্থা করতে হয় এজেন্টদেরই। তাই শিপিং এজেন্টরা ওয়াচম্যান নিতে অস্বীকৃতি জানায়।'
বন্দর কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, জলসীমার উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকায় নজরদারি করে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। দেশের সমুদ্রসীমার বাকি অংশ নজরদারি করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের (পূর্ব জোন) কমান্ডার এম আশফাক বিন ইদ্রিস বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দর জলসীমায় সার্বক্ষণিক টহল কার্যক্রম চলমান থাকে। ৩টি জাহাজ সার্বক্ষণিক মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরসীমায় ২০২১ সাল থেকে কোনো ধরনের দস্যুতার ঘটনা ঘটেনি।'