ভোজ্যতেলের ভ্যাট প্রত্যাহারের উদ্যোগ কতটুকু উপকারে আসবে ভোক্তার?
ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের উপর ভ্যাট ও শুল্ক কমানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর মধ্যে ভোজ্যতেলের উৎপাদন ও ট্রেডিং পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি পর্যায়ে না কমিয়ে কেবল আলোচ্য দুটি স্টেজে ভোজ্যতেলের উপর ভ্যাট কমালে তাতে ভ্যাট কমবে খুবই সামান্য। কেননা ভ্যাটের বড় অংশই পরিশোধ করতে হয় আমদানি পর্যায়ে। এতে ভোজ্যতেলের দাম কমার ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব পড়বে না বলে মনে মনে করেন আমদানিকারকরা।
সম্প্রতি এক আদেশে চিনির হ্রাসকৃত রেগুলেটরি ডিউটি সুবিধা আড়াই মাসের জন্য বর্ধিত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও চিনির উপর বিভিন্ন ধরণের শুল্ক-কর রয়ে গেছে, যা বাজারে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখছে। চিনির উপর ১০ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি কমানোর পরও প্রতি মেট্রিক টনে ৩০০০ টাকা স্পেসিফিক ট্যাক্স, ১৫% ভ্যাট, ২০% রেগুলেটরি ডিউটি ও ২% অ্যাডভান্স ট্যাক্স রয়েছে।
অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিলেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভোজ্যতেলের উপর ভ্যাট কমানোর আদেশ জারি করেনি। আগামী সপ্তাহে তা কমানোর আদেশ জারি হবে বলে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া ছোলার ওপর আগে থেকেই কোন ধরণের শুল্ক-কর নেই।
বর্তমানে ভোজ্যতেল আমদানি পর্যায়ে ১৫%, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫% ও ট্রেডিং পর্যায়ে ৫% ভ্যাট রয়েছে। কিন্তু ভ্যাটের মূল অংশ আদায় হয় আমদানি পর্যায়ে। উৎপাদন ও ট্রেডিং পর্যায়ে মূল্য সংযোজনের পরিমাণ কম হওয়ায় এখাতে ভ্যাটের পরিমাণও কম। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোজ্য তেলসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূলত দায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে দর বেড়ে যাওয়া। ওই বর্ধিত দরের উপরই ভ্যাট আদায় করা হয়। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজনে হেরফের খুবই কম।
অথচ অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট না কমে কমতে যাচ্ছে বাকি দুইটি স্টেজে। দৃশ্যত ভ্যাট অনেক কমছে বলে মনে হলেও বাস্তবে পরিস্থিতি তা নয়।
দেশের অন্যতম বড় ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী আমদানি পর্যায়ে ২২ টাকা ও স্থানীয় পর্যায়ে অ্যাডেড ভ্যালুর উপর ৬ টাকা সহ মোট ২৮ টাকা ভ্যাট আসবে প্রতি লিটারে। স্থানীয় পর্যায়ে যে ভ্যাট কমানোর কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে বাস্তবে ৬ টাকার ভ্যাট সেভ হতে পারে কিংবা আরো কম। যদি এভাবেই এনবিআর আদেশ জারি করে, তা হবে এক ধরণের 'আইওয়াশ'। ভোজ্যতেলের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে এই পদক্ষেপ বিশেষ কোন কাজে আসবে না।"
তিনি আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট কমানো উচিত উল্লেখ করে বলেন, "প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এটি সম্ভব হবে না।"
আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দুই বছর আগে প্রতি মেট্রিকটন তেল আমদানিতে ৭০০ ডলার খরচ হলেও বর্তমানে লেটার অব ক্রেডিট খোলা হচ্ছে প্রায় ২ হাজার ডলারে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভ্যাটের হার একই থাকার পরও ভ্যাট বাবদ ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। অথচ এনবিআর আমদানির ভ্যাট কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে না।
এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ভোজ্য তেল থেকে সরকার বছরে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করে। তবে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডের অর্থ ও হিসাববিভাগের প্রধান দিদার-মোহাম্মদ দবিরুল ইসলাম হিসাব করে জানিয়েছেন, বর্তমান বাজারদর বিবেচনায় সরকারের ভ্যাট প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, সরকারের বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী, এতে সর্বোচ্চ ৫০০ কোটি টাকার ভ্যাট সেভ হতে পারে, যা বাজারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য যথেষ্ট নয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন দুই লাখ টন। এছাড়া সয়াবিন ও পামঅয়েল আমদানির মাধ্যমে বাকি ১৮ লাখ টনের চাহিদা পূরণ করা হয়।
টিসিবির জন্য ১ কোটি ৭১ লাখ লিটার সয়াবিন তেল কিনবে সরকার
এদিকে বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ভার্চুয়াল সভায় চারটি পৃথক প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়।
প্রস্তাব অনুযায়ী, আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে তেল, চিনি, ছোলা ও মসুর ডাল কিনবে সরকার। এরমধ্যে ১ কোটি ৭১ লাখ লিটার সয়াবিন তেল, ১৪ হাজার টন চিনি, ১০ হাজার টন ছোলা এবং ১৯,৫০০ টন মসুর ডাল ক্রয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬৯২ কোটি টাকা।