বাড়তি আমদানিতেও কমছে না ভোজ্যতেলের দাম
সরবরাহ আদেশের (এসও) বিপরীতে ভোজ্যতেল বিক্রির আইনি প্রক্রিয়া ছিল। সেটি প্রতিপালন না করে আইনত নিষিদ্ধ ডেলিভারি অর্ডারের (ডিও) ব্যবসা করছে আমদানিকারক থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরাও। নিয়মে ডিও বিক্রির ১৫ দিনের মধ্যে ভোজ্যতেল সংগ্রহের শর্ত থাকলেও উভয়পক্ষের যোগসাজশে সেটি পড়ে থাকছে বছরের পর বছর। বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক দাম বেড়ে গেলে সেই কৌশলই এখন গলার কাঁটা দুই পক্ষের জন্য। দীর্ঘদিন ধরে কম দামে বিক্রি করা ডিও'র পণ্য উত্তোলন না হওয়ায় এখন মিলগেট থেকে সরবরাহ দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে খোদ মিল মালিকরাই। এতে ভোজ্যতেলের দাম কমাতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ কাজে আসছে না। সপ্তাহখানেক নিম্নমুখী থেকে ফের বাড়ছে এ নিত্যপণ্যটির দাম।
দেশের অধিকাংশ আমদানি বাণিজ্য হয় ব্যাংকিং চ্যানেলে। বিশ্ববাজার থেকে পণ্য বুকিং দিয়ে ঋণপত্র (এলসি) নিয়ে পণ্য আমদানি করে ব্যবসায়ীরা। পণ্যের সমপরিমাণ অর্থ দেয়ার পরিবর্তে নামমাত্র টাকা জমা নিয়ে পণ্য আমদানিতে বিনিয়োগ করে ব্যাংক। ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানির আগেই বিপুল পরিমাণ অর্থ ডিও বিক্রির মাধ্যমে বাজার থেকে সংগ্রহ করে। সুদ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা না থাকায় কম দামে বিক্রি করা এসব ডিও দিয়ে ভোজ্যতেল সরবরাহ করছে অনাগ্রহী মিলাররা।
দীর্ঘদিনের পুরনো এসব ডিও'র বিপরীতে ভোজ্যতেল সরবরাহ দিতে অনীহা দেখাচ্ছেন মিল মালিকরা। ফলে পর্যাপ্ত আমদানি, শুল্ক ছাড়ের প্রভাব নেই পাইকারি বাজারে।
খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আমদানিকারকরা তেল আমদানির কয়েক মাস আগেই বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা উত্তোলন করে নেয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে ডিও বিক্রি করে নেয়া এ টাকা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত ব্যবহার করা সম্ভব। ভোজ্যতেল সংগ্রহের ১৫ দিনের সময়সীমা থাকলেও আমদানিকারকদের মৌন সম্মতি এবং ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর স্লিপ বাণিজ্যের কারণে ডিও অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বাজারে পড়ে থাকে। যার কারণে বছরের পর বছর দেশের বাজারে ডিও-গুলো হাতবদল হয়। তবে বছরের অধিকাংশ সময়ই বাজার স্থিতিশীল থাকায় দীর্ঘদিন আগে বিক্রি করা ডিও দিয়ে কেউ ভোজ্যতেল সংগ্রহ করতে চাইলে সমস্যা হতো না। সম্প্রতি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে মাত্র এক সপ্তাহেই ভোজ্যতেলের দাম মণপ্রতি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। ফলে পাইকারি বাজারে হাতবদল হতে থাকা দীর্ঘদিনের সব ডিও এখন সময়ের সর্বোচ্চ লাভে অবস্থান করছে। এ কারণে সবাই ভোজ্যতেল উত্তোলন করতে চাইলেও সেই পরিমাণ ভোজ্যতেল সরবরাহ দিচ্ছে না কারখানা মালিকরা। এর প্রভাব পড়ছে দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে।
বাজারের ডিও ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগেও বাজারে আমদানিকারকরা মণপ্রতি সয়াবিনের এসও বিক্রি করেছে ৫ হাজার ৮০০ টাকায়। পরবর্তী সময়ে পণ্য সংকটের আশঙ্কায় দেশের বাজারে কয়েক দিনের ব্যবধানে সয়াবিনের দাম উঠে যায় মণপ্রতি ৬ হাজার ৮০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ২০০ টাকায়। এছাড়া গত কয়েক বছর পাইকারি বাজারে বর্তমান দামের অর্ধেক মূল্যে বিক্রি করা ডিও রয়েছে। এসব ডিও যেসব ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্রোকারের রয়েছে, তারা দেড় গুণ থেকে দ্বিগুণ লাভে থাকায় দ্রুত মিলগেট থেকে ভোজ্যতেল সংগ্রহ করতে যাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের পুরনো ডিও'র বিপরীতে ভোজ্যতেল সরবরাহ দিতে এখন মিল মালিকরা অনীহা দেখাচ্ছেন।
সম্প্রতি দেশের শীর্ষস্থানীয় একাধিক ভোজ্যতেল পরিশোধন মিলের কাছে গিয়ে ব্যবসায়ীদের পাঠানো ট্রাক দিনের পর দিন অপেক্ষা করছে। এতে প্রতিদিনই ট্রাকপ্রতি আড়াই হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। মিলগেট থেকে দ্রুত পণ্য উত্তোলনে তদবির ছাড়াও অন্যায্য পন্থায় ঘুষ প্রদানেরও অভিযোগ উঠেছে। যার কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মিল থেকে পণ্য উত্তোলন করতে না পারায় কম দামের কেনা পণ্যের কস্টিং মূল্যও বাড়ছে বলে দাবি করেছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
ডিও ব্যবসায়ী মেসার্স জিএম ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী এম হায়দার আলী বলেন, ছয় মাস আগের কেনা কয়েকটি ডিও নিয়ে একটি কারখানায় তেল সরবরাহ করতে যান তিনি গত মঙ্গলবারে। দুই দিন পার হলেও এখনো কোম্পানিটি ভোজ্যতেল সরবরাহ দেয় নি। ফলে সরবরাহ নিতে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের জন্য প্রতিদিন আড়াই হাজার টাকা করে গচ্চা দিতে হচ্ছে।
ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নূরজাহান গ্রুপের পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ভোজ্যতেলে বৈশ্বিক বাজার ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে। ২০০৮-২০১০ সালেও একই পরিস্থিতি ছিল। ঝুঁকি বিবেচনায় দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক প্রতিষ্ঠানই সক্ষমতার চেয়েও আমদানি বুকিং কমিয়ে দিয়েছে। যার কারণে সরবরাহ চেইনে কিছুটা সমস্যা থাকবেই। সরকার ভোজ্যতেলসহ অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় চারটি পণ্য আমদানিতে জুন পর্যন্ত ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে। এক্ষেত্রে পণ্য আমদানির আগে এসও বিক্রির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ সমস্যা দায়ী থাকলেও একমাত্র কারণ নয় বলেই মনে করেন তিনি।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুই মাসে ১ লাখ ৬৯ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। গত বছর একই সময়ে অপরিশোধিত সয়াবিন আমদানির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২১ হাজার টন। সেই হিসেবে, গত বছরের তুলনায় ৪৮ হাজার টন সয়াবিন বেশি আমদানি হয়েছে।
একইভাবে গতবারের তুলনায় এবারে ৪০ হাজার টন বেশি সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে। গত বছর প্রথম দুই মাসে সয়াবিন আমদানির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭১ হাজার টন। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ১১ হাজার টন।
গত বছর প্রথম দুই মাসে পাম অয়েল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৯৯ হাজার টন। ২০ হাজার টন বেড়ে এবারে পাম অয়েল আমদানির পরিমাণ ২ লাখ ১৯ হাজার টন।
দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের ঊর্ধ্বমুখী সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে তিনটি জাহাজ। এই তিন জাহাজে আছে ৭৫ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল। আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর সূত্রে জানা গেছে, এই অপরিশোধিত সয়াবিন তেল পরিশোধন করে রোজায় বাজারজাত করবে তারা।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, প্রায় ৩২ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন নিয়ে বন্দর জলসীমায় এসে পৌঁছেছে দুটি জাহাজ। আগামী শনিবার আরও ৪৩ হাজার টন সয়াবিন তেল নিয়ে আরেকটি জাহাজ আসার কথা রয়েছে। সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল, টিকে গ্রুপ ও সেনা এডিবল অয়েল লিমিটেড এই সয়াবিন তেল আমদানি করেছে। এর আগে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাম তেল এসেছে ১২ হাজার টন। আরেকটি জাহাজে আনা হয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার টন সয়াবীজ। সয়াবীজ মাড়াই করে প্রাণিখাদ্য সয়ামিলের পাশাপাশি অপরিশোধিত সয়াবিন তেল তৈরি করা হয়।
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, 'প্রায় কাছাকাছি সময়ে সয়াবিন তেলবাহী তিনটি জাহাজের আগমন দেশে এই পণ্যের সংকট হওয়ার যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তা ঘোচাবে। বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম বাড়ছে। এরপরও আমদানি অব্যাহত রেখেছি আমরা। নতুন আসা সয়াবিন তেলের চালান দ্রুত খালাস ও পরিশোধন করে বাজারজাত করা হবে। এর বাইরে নতুন করে ঋণপত্র খোলা হয়েছে।'
নতুন আসা চালান আগের চেয়ে বাড়তি দামে কিনতে হয়েছে বলে জানান তিনি।