সীমার বাইরে ঋণ দিয়েছে ১১ বাণিজ্যিক ব্যাংক
ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা বাড়াতে ঋণ আমানত অনুপাত সীমা (এডিআর) বাড়ানো হয়েছে। তারপরও আগ্রাসী বিনিয়োগ ঠেকাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এডিআর সীমার বাইরে ঋণ দিয়েছে সরকারি-বেসরকারি ১১ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা এডিআর নিয়ে জানুয়ারির রিপোর্টে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত আইনে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে টানা পাঁচবার এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তারপরও অনেক ব্যাংক এটি সমন্বয় করতে পারেনি।
২০২০ সালের মার্চের পর থেকে কোভিডের কারণে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে গতিশীলতা আনতে এডিআর ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, এখন প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা এবং ইসলামী শরিয়াভিত্তিক পরিচালিত ব্যাংকগুলো ৯২ টাকা পর্যন্ত ঋণ বা বিনিয়োগ করতে পারে। এ সুবিধা পাওয়ার পরও ১১টি ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রচলিত ধারার রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯০ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এছাড়া বেসরকারি এবি ব্যাংকের ৮৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৯১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, পদ্মা ব্যাংকের ৯৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ, এনআরবিসি ব্যাংকের ৮৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং দেশে পরিচালত বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাংক আল-ফলাহ সীমা অতিক্রম করে ঋণ দিয়েছে ৮৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।
এছাড়া ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইনি সীমার বাইরে বিনিয়োগ রয়েছে বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৪ দশমিক ২১ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯২ দশমিক ১৫ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ২০ শতাংশ এবং পূবালী ব্যাংকের শরীয়াহ শাখা সীমালঙ্ঘন করে বিনিয়োগ করেছে ৯৬ দশমিক ১৪ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে ঋণ বা বিনিয়োগ করাকে এ খাতের জন্য ভালো চোখে দেখছেন না অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, "আমানতের বিপরীতে ব্যাংক কত টাকা ঋণ দিতে পারবে তার একটা সীমা নির্ধারণ করা দেওয়া আছে। তারপরও কয়েকটি ব্যাংক সীমা লঙ্ঘন করে কেন ঋণ দিচ্ছে এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেখা উচিত।"
ব্যাংকগুলো কেন বেশি ঋণ দিচ্ছে তা তদারকি করে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকই ঠিক করবে বলে তিনি জানান।
আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি দিলে ব্যাংক ঝুঁকিতে থাকে জানিয়ে মির্জা আজিজুল বলেন, ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ের চিত্র এখন খুব একটা সন্তোষজনক নয়; এমন অবস্থায় অতিরিক্ত ঋণ দিয়ে যদি খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যায় এতে করে আমানতকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কাও থাকে। তাই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ দরকার বলে জানান সাবেক এ অর্থ উপদেষ্টা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "যে ব্যাংকগুলো এডিআর সীমা অতিক্রম করেছে কোনো কারণে যদি খেলাপি হয়ে যায় তাহলে গ্রাহকের টাকা দিতে পারবে না। সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মের মধ্যে আসতে হবে। এটা ঠিক করতে হলে ঋণ বিতরণ কমাতে হবে একইসঙ্গে ডিপোজিট বাড়াতে হবে।"
বেসরকারি পূবালী ব্যাংকের কনভেনশনাল ব্যাংকিংয়ে এডিআর স্বাভাবিক ধারায় থাকলেও ইসলামি ব্যাংকিং শাখায় এডিআর সীমা অতিক্রম করেছে। এ বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সাইফুল আলম খান চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কনভেনশনাল ব্যাংকিংয়ে আমরা এখনও নিয়মের মধ্যে আছি। ২০২১ সালে আমরা প্রচুর ঋণ দিয়েছি। আমাদের পোর্টফোলিও বাড়ছে। তবে আমাদের অ্যাডভান্স গ্রোথ যে পরিমাণে হয়েছে সেই পরিমাণে আমানত বাড়েনি এতে এডি অনুপাত কিছুটা বেড়েছে।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, "আমানতের বিপরীতে কত টাকা ঋণ দিতে পারবে এর একটি সীমা নির্ধারিত করে দেওয়া আছে। তবে এ আমানতের অনুপাত বিভিন্ন সময় পরিবর্তন ঘটে। কারণ হঠাৎ করে বড় আমানত ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা বেড়ে যায়; অনুরূপ কোনো গ্রাহক আমানত তুলে নিলে তখন ঋণ দেওয়া ক্ষমতা কমে যায়। তখন ব্যাংক তার এডিআর সীমার বাইরে চলে যায়। এটা স্বাভাবিকভাবে হতে পারে।"
"তবে আমরা যেটা বেশি নজর দেই তা হলো দীর্ঘমেয়াদী এডিআর সীমার বাইরে কোনো ব্যাংক রয়েছে কি না, থাকলে কেন রয়েছে তা তদারকি করি। অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকে এডিআর না কমালে ঋণ দিতে পারবে না বলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এমনইভাবে অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে," বলেন ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার এই মুখপাত্র।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঋণ বিতরণ করেছে ১২ লাখ ৩৪ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। যা মোট আমানতের ৭৩ দশমিক ৭০ শতাংশ।