প্রাইভেট মার্কেটপ্লেস গড়ে তুলবে বসুন্ধরা গ্রুপ
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গ্রুপ বসুন্ধরা গ্রুপ প্রাইভেট মার্কেটপ্লেস গড়ে তুলতে যাচ্ছে, যেখানে একই সঙ্গে সব ধরণের পণ্য বিজনেস-টু-বিজনেস ও বিজনেস-টু-পারসন কেনাবেচা ছাড়াও বার্টার, অকশন, গুদামজাতকরণ ও সিকিউরিটিজ লেনদেনের সুযোগও থাকবে।
'এবিজি মার্কেটপ্লেস' নামে একটি গ্লোবাল মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠার অনুমোদন চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বিষয়টি জরুরিভাবে দেখভালের জন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। ই-কমার্স নির্দেশিকা মেনে মার্কেটপ্লেস ব্যবসা শুরু করার অনুমতি দিয়ে চলতি সপ্তাহেই বসুন্ধরা গ্রুপকে চিঠি দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ধরণের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ ব্যবস্থা বা মার্কেটপ্লেস গড়ে উঠেনি। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কমোডিটি এক্সচেঞ্জের অনুমোদন পেলেও তা এখনও শুরু করেনি সংস্থাটি। বসুন্ধরা গ্রুপ আশা করছে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রয়োজনীয় লাইসেন্স ও অনুমোদন নেওয়ার পর আগামী ৬ মাসের মধ্যে মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠার কাজ দৃশ্যমান হবে। মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠায় ইতোমধ্যে এবিজি লিমিটেড নামে একটি স্বতন্ত্র কোম্পানি গঠন করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ, যার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন গ্রুপটির এমডি সায়েম সোবহান আনভীর।
এবিজি মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠার অনুমোদন চেয়ে গত ১৬ মার্চ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কাছে আবেদন করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। এটি প্রতিষ্ঠা পেলে কৃষক, উৎপাদনকারী, মধ্যম আয়ের জনসাধারণ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কর্মহীন জনগোষ্ঠীসহ সর্বস্তরের জনগণ উপকৃত হবে বলে জানিয়েছে গ্রুপটি।
আবেদনে গ্রুপটি লিখেছে, 'জনবান্ধব তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকার সমস্যা লাঘব, বিনিয়োগের জন্য নির্ভরযোগ্য নতুন ক্ষেত্র এবং স্বনির্ভর উদ্যোক্তা শ্রেণী সৃষ্টির লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে আমরা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মার্কেটপ্লেস পরিচালনা করতে অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করছি।'
এবিজি লিমিটেডের আওতাধীন এবিজি মার্কেটপ্লেস নামে একটি প্রাইভেট মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা চেয়েছে গ্রুপটি।
এবিজি লিমিটেডের পরিচালক ও বসুন্ধরা গোল্ড রিফাইনারির কোম্পানি সেক্রেটারি শাহরিয়ার মোল্লা স্বাক্ষরিত আবেদনে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত প্রাইভেট মার্কেটপ্লেসটি সাধারণ মার্কেটপ্লেসের দেওয়া সব ধরণের সেবা সরবরাহ ও পরিচালনা করবে। এতে ক্রেতা-বিক্রেতার পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য প্লাটফর্ম প্রদান, ট্রেডারদের তালিকাভুক্তকরণ, স্পট বিক্রির সুযোগ, সেবা বা সিকিউরিটিজ কেনা-বেচা, বৈদেশিক বিনিয়োগে স্থানীয় ও বিদেশিদের সংযোগ স্থাপন, গুদামজাতকরণ ও স্থানান্তরকরণের সুযোগ থাকবে।
'এছাড়াও কৃষিপণ্য, তুলা, মেটাল, ব্রোকারিং, অকশন, ডেরিভেটিভস, বার্টার, টিকেটিং, প্রাইস ইনডেক্স, ই-জব সাইট, প্লাস্টিক আইটেম, শিপ চার্টারিং, গার্মেন্টস কাঁচামাল ও উপকরণ, নির্মাণ উপকরণ, মাংসীয় পণ্যও এর অন্তর্ভুক্ত হবে', যোগ করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ।
শাহরিয়ার মোল্লা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আলিবাবা, অ্যামাজন মূলত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এবিজি মাকের্টপ্লেস হবে এমন একটি প্লাটফর্ম যেখানে বিটুবি এবং বিটুপি পণ্য কেনাবেচা করা ছাড়াও বার্টার ও ইনভেস্টমেন্টের সুযোগ থাকবে। অর্থাৎ, যে কোন ব্যক্তি তার সামর্থ অনুযায়ী ৫০০ বা ১০০০ টাকা বিনিয়োগ করে এই প্লাটফর্মে পণ্য কিনতে পারবেন। পরে যখন ওই পণ্যের দাম বাড়বে, তখন তিনি তা চাইলে আবার বিক্রি করে লাভবানও হতে পারবেন।
দেশ-বিদেশের সকল ব্রান্ড এই মার্কেটপ্লেসে যুক্ত হতে পারবে। এই মার্কেটপ্লেস ব্যবহার করে দেশি পণ্য ও সেবার পাশাপাশি বিদেশি পণ্যও কেনা, আবার বাংলাদেশি পণ্য ও সেবা বিদেশি ক্রেতাদের কাছেও সরবরাহ করা যাবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেবো আমরা।
প্রস্তাবিত মার্কেটপ্লেস যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ানগোল্ড-এর মতো হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এবিজি মার্কেটপ্লেসে লেনদেন হওয়া সব পণ্যের বীমা করা থাকবে। অফিস স্টাফ, পণ্যের ক্রেতা-বিক্রেতা, বিনিয়োগকারী, ডেলিভারিম্যানসহ প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ করে কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করছি আমরা।
প্রস্তাবিত মার্কেটপ্লেসে বসুন্ধরা গ্রুপ কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে, তা জানাতে রাজি হননি এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বসুন্ধরা যেখানেই বিনিয়োগ করেছে, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারসহ বড় আকারে বিনিয়োগ করেছে। এক্ষেত্রেও গ্রুপটি বড় আকারে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে ই-কমার্স গাইডলাইন জারি করেছে, সেটি মেনে বসুন্ধরা গ্রুপ যেকোন সময় ব্যবসা শুরু করতে পারবে বলে আগামী দু-তিন দিনের মধ্যেই মন্ত্রণালয় থেকে বসুন্ধরা গ্রুপকে চিঠি দিয়ে জানানো হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আলাদাভাবে অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে তারা ব্যবসা শুরু করতে পারে। তবে মার্কেটপ্লেসে যে ধরণের পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় বা এক্সচেঞ্জ হবে, সেসব পণ্য ও সেবা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। ই-কমার্স গাইডলাইনে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলা আছে।
বসুন্ধরা গ্রুপ বলেছে, দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ স্বল্পতা থাকায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধার অভাবে ভুগছে। সদিচ্ছা থাকা সত্বেও বিনিয়োগ করার মতো বিকল্প না থাকায় তাদের চাকরির বেতন বাদে অর্থ উপার্জনের দ্বিতীয় কোন পথ নেই। এ অবস্থা হতে উত্তরণে প্রস্তাবিত মার্কেটপ্লেস মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য স্বল্প পুঁজিতে বিনিয়োগের নতুন একটি ফলপ্রসূ ও যুগান্তকারী খাত তৈরি করবে।
'মার্কেটপ্লেসের সঙ্গে জড়িত অবকাঠামো উন্নয়নের সামগ্রিক ব্যাপকতা, পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত জটিলতা, বাজারে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অস্থিরতা দূর করে এবিজি মার্কেটপ্লেস একটি স্থিতিশীল অবস্থায় যেতে পারবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। তবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের পূর্ণ অনুমোদন ছাড়া বিনিয়োগকারী বা অন্যান্য স্টেকহোল্ডাররা এই বিশাল উদ্যোগে তাদের মূল্যবান সময় ও অর্থ ব্যয় করতে আগ্রহী হবে না', আবেদনে যোগ করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস এর সাবেক প্রেসিডেন্ট একেএম ফাহিম মাশরুর টিবিএসকে বলেন, 'বসুন্ধরা গ্রুপ যে মার্কেটপ্লেস করতে চাচ্ছে, তা ই-কমার্স নয়, বরং অনেকটা কমোডিটি এক্সচেঞ্জের মতো। বাংলাদেশে এ ধরণের ইনভেস্টমেন্ট একেবারেই নতুন, তবে এখাতের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের সঞ্চয় বিনিয়োগ করার মতো বিকল্প পন্থা নেই। তাদের জন্য নতুন একটি দরজা খুলে যাবে।'
বসুন্ধরা গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠা করা একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এজন্য প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার প্রয়োজন হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অনুমোদন নিয়ে আগামী ৫-৬ মাসের মধ্যে মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠার কাজ পুরোদমে শুরু হবে। প্রথম থেকেই এই মার্কেটপ্লেসে ড্রাগ, গোল্ডসহ সব ধরণের পণ্য ও সেবা থাকবে। প্রবাসী বাংলাদেশিসহ বিদেশিরাও এখানে বিনিয়োগ করতে পারবে। তবে বাংলাদেশিদের অগ্রাধিকার থাকবে।