সরবরাহ কমিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরী করছে ভোজ্যতেলের রিফাইনারি কোম্পানিগুলো
স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে আনা, অর্ডার নিয়েও তেলের সরবরাহ না করা, রিফাইনারি ইউনিট বন্ধ রাখা, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে লেবেলিং এর মত নানা অনিয়মের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের বাজারে সংকট তৈরি করেছে ভোজ্যতেলের রিফাইনারি কোম্পানিগুলো। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আইনের ব্যত্যয়কারী ভোজ্যতেল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পাঁচ সদস্যের তদারকি টিম দেশের ছয়টি এডিবল অয়েল রিফাইনারি কোম্পানি সরেজমিন ইন্সপেকশন করেছে মার্চের মাঝামাঝিতে। তাতে সব কোম্পানিই জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমানোসহ বিভিন্ন অনিয়ম পেয়েছে। এ বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন গত ৩ এপ্রিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে অধিদপ্তর।
তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, অপরিশোধিত তেলের মজুদ থাকা সত্ত্বেও রিফাইনারি ইউনিট বন্ধ রাখে এস আলম সুপার এডিবল অয়েল কোম্পানি। কোম্পানি ডিলারদের কাছ থেকে সরবরাহ অর্ডার নিয়ে তা দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামের কনজ্যুমার প্যাক মজুদ করে রাখে। অপরিশোধিত তেলের মজুদ থাকা সত্ত্বেও গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চ মাসে ভোজ্যতেলের সরবরাহ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমিয়ে দেয় কোম্পানিটি।
অধিদপ্তরের তদন্তে উঠে এসেছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ভোজ্যতেলের সরবরাহ ছিল ১৪,৫৭৯ মে. টন। চলতি বছরের জানুয়ারীতে সরবরাহ দাঁড়ায় ২০,৪৮৭ মে. টন, ফেব্রুয়ারীতে ১৭,১৬৪ মে. টন এবং মার্চের ১৯ তারিখ পর্যন্ত এই সরবরাহ একেবারেই কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৬৩১০ মে.টনে।
এছাড়া, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল কোম্পানির সরবরাহ করা খোলা ভোজ্যতেলের ড্রামে তেলের নাম (সয়াবিন/পামঅয়েল) সম্পর্কিত কোন তথ্য পায়নি অধিদপ্তর।
কেবল এস আলম গ্রুপের কোম্পানিই নয়, সিটি এডিবল অয়েল লিমিটেড, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড, শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মেঘনা ও ইউনাইটেড এডিবল অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড, বসুন্ধরা অয়েল রিফাইনারি মিল ফেব্রুয়ারী মাসের তুলনায় মার্চে সরবরাহ উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস করে। সিটি, মেঘনা, টিকের রিফাইনারিতে ডিলারদের কাছ থেকে সাপ্লাই অর্ডার নেয়া হলেও সেগুলো দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হয়েছে। যার প্রভাবে খুচরা বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকট তৈরি হয় এবং বাজারে সয়াবিন তেল উধাও হয়ে যায়।
অধিদপ্তরের সুপারিশে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে যাতে ভোজ্যতেল রিফাইনারিগুলো এ ধরণের কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি করতে না পারে, সেজন্য মিলগেটে নিয়মিত তদারকির জন্য যৌথ টিম মোতায়েন করা দরকার।
শুধু যে রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ম করেছে তাই নয়, ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরাও ভোজ্যতেলের অবৈধ মজুদ ও মূল্যবৃদ্ধিসহ অন্যান্য অনিয়ম-অসঙ্গতিতে জড়িত বলে তথ্য প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত দল। ফলে ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও আইনী ব্যবস্থা নিতে বলেছে সংস্থাটি।
সোমবার সচিবালয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ভোজ্যতেলের অবৈধ মজুদ ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সঙ্গে কোন রিফাইনারির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে এস আলম গ্রুপের সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক কাজী সালাহউদ্দিন আহাম্মদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মেইনটেন্যান্সের জন্য দু-তিন দিন শুধু সয়াবিনের প্রডাকশন লাইন বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু পাম অয়েলের রিফাইনারি লাইন ঠিক ছিল।
'রিফাইনারি ইউনিট বন্ধ রাখার পেছনে আমাদের কোন ইনটেনশন ছিল না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের যে টিম ইন্সপেকশনে এসেছে, তারাও বিষয়টি বুঝতে পেরেছে।'
সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দাম উল্লেখ করে বোতল মজুদ করার কারণ হিসেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এখানে একটা ভুল হয়েছিল। ১, ২ ও ৩ লিটারের বোতলে কোন সমস্যা ছিল না। ভুল করে ৫ লিটারের বোতলে বেশি দাম উল্লেখ করা হয়েছিল, যা আমরা পরে দ্রুত ঠিক করেছি।'
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ভোজ্যতেল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলো সয়াবিন তেলের প্রতি লিটারে ১২ টাকা দাম বৃদ্ধির অনুমতি চায়। কিন্তু সরকার দাম বৃদ্ধির অনুমতি না দিলে রিফাইনারি ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়। ১৬৮ টাকার তেল ১৮০-১৯০ টাকায় উঠে যায়। সরবরাহ একেবারে কমিয়ে আনার কারণে খুচরা বাজার তেলশূন্য হয়ে পড়ে এবং ভোক্তারা বিপাকে পড়ে।
বাজারে ভোজ্যতেল নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার এই প্রেক্ষাপটে গত ৯ মার্চ মিল মালিকদের সঙ্গে সভা করে অধিদপ্তর। ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী ও ডিলাররা অভিযোগ করেন যে, মিলগুলোতে সাপ্লাই অর্ডার করলে তা ডেলিভারি পেতে ১৫ দিন থেকে এক মাস সময় লাগে এবং ট্রাকগুলোকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া, মিলগুলো সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দাম নেয়। মিল থেকে তেল নেওয়ার সময় সাপ্লাই অর্ডারে পণ্যের একক মূল্য লেখা থাকে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
সেখানে উপস্থিত ভোজ্যতেলের মিলাররা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সাপ্লাই অর্ডার পাওয়া মাত্রই যথাসময়ে সরকার নির্ধারিত মূল্যেই তেল সরবরাহ করছেন তারা।
এ প্রেক্ষাপটে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে রিফাইনারিগুলো সরেজমিন ইন্সপেকশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে পরদিন থেকে ইন্সপেকশন শুরু করে অধিদপ্তর। শুরুতে সিটি এডিবল অয়েল লিমিটেড পরিদর্শনকালে মেয়াদোত্তীর্ণ সাপ্লাই অর্ডার পান তারা। এছাড়া, কোম্পানিটির খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের সরবরাহ সংকুচিত করার তথ্যও পান তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিত সাহা টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের কোন সমস্যা ছিল না। যাদের সমস্যা ছিল তাদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরংক্ষণ অধিদপ্তর। আমাদের কাছে কোন ব্যাখ্যা চায়নি। সমস্যা থাকলে তো ব্যাখ্যা চাইতো।'
রূপচাঁদা ব্রান্ডের তেল উৎপাদক বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডও গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় মার্চে কম তেল বাজারে সরবরাহ করেছে বলে দেখতে পায় ইন্সপেকশন টিম।
টিকে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড পরিদর্শনকালে মেয়াদোত্তীর্ণ সাপ্লাই অর্ডার পাওয়া ছাড়াও আগের দুই মাসের তুলনায় মার্চে কম তেল সরবরাহ করার তথ্য পায় তারা।
ফ্রেশ ব্রান্ডের ভোজ্যতেলের উৎপাদক মেঘনা ও ইউনাইটেড এডিবল অয়েল রিফাইনারি পরিদর্শন করেও একই তথ্য পায় ইন্সপেকশন টিম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিকে গ্রুপের পরিচালক (অর্থ ও পরিচালনা) মোঃ শফিউল আতহার তসলিম বলেন, 'জানুয়ারী মাসের চেয়ে ফেব্রুয়ারী মাসের দিন কম। কিন্তু তুলনাটা সেভাবেই করা হয়েছে। আবার মার্চের ২৭-২৮ তারিখের দিকে এসে আমাদের তথ্য দেখা হয়েছে। মাত্র ৭৯৫ টন তেল মার্চে কম সাপ্লাই হয়েছে, যেটা হয়তো মাস শেষ হলে থাকতো না।'
সাপ্লাই অর্ডার নিয়ে যে সমস্যা ছিল, তা এখন দূর হয়েছে বলেও জানান তিনি।
গত ২০ মার্চ বসুন্ধরা অয়েল রিফাইনারি পরিদর্শনকালে দেখতে পায় কোম্পানিটিও জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে কম পরিমাণ ভোজ্যতেল সরবরাহ করেছে।
ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং আমদানি পর্যায়ে ১০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। এর পরপরই অবশ্য বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৬৮ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬০ টাকা করা হয়।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজরে যখন ভোজ্যতেলের দাম উর্ধ্বমুখী তখন সরকার ভোজ্যতেল আমদানি ও উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভ্যাট কমিয়ে স্থানীয় বাজারে দাম কমিয়ে দেয়। কিন্তু মেঘনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেয়া এক চিঠিতে দাবি করেছে, সরকার সর্বশেষ যে দাম নির্ধারণ করেছে তা সয়াবিনের ১৪০০ মার্কিন ডলার এবং পাম অয়েলে ১২৯৫ মার্কিন ডলার বেসিস ধরে। কিন্তু মেঘনা এডিবল অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড ১৬০০ মার্কিন ডলার মূল্যে পাম অয়েল আমদানি করেছে। যে দাম তারা সমন্বয় করতে না পারলে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়বে বলে চিঠিতে তুলে ধরা হয়।