দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে শ্রমিকদের স্বস্তি দিতে কারখানাগুলো যে উদ্যোগ নিলো
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঊর্মি গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন অ্যাটায়ারস ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেডের কর্মী লিপি আক্তার। রমজান শুরু হওয়ার আগে থেকেই তার কারখানা কর্তৃপক্ষ বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে ভোজ্য তেল, চিনি, লবণ, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কারখানা প্রাঙ্গণে বিক্রি শুরু করেছে। এখান থেকে তিনিও গত সপ্তাহে ৮২৭ টাকার পণ্য কিনেছেন।
তার কেনা পণ্যের মধ্যে পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেল রয়েছে, যার দাম বর্তমানে বাজারে ৭৯৫ টাকা, কিন্তু তার কারখানা কর্তৃপক্ষ দিয়েছেন ৭২০ টাকায়।
কেবল তিনিই নন, ঊর্মি গ্রুপের ৪টি কারখানার বেশিরভাগ শ্রমিক কারখানা প্রাঙ্গণ থেকে এসব পণ্য কিনেছেন এবং তাও বাকিতে। মাস শেষে বেতনের টাকা থেকে তাদের এই টাকা কেটে নেবে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
লিপি আক্তার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, "আমার ১৩ বছরের চাকরিজীবনে এই প্রথম এমন সুবিধা পেয়েছি। বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, কিন্তু এখানে বাজারের চেয়ে কম দামে কিনতে পারছি এবং বাকিতে। মালিকপক্ষ কতদিন এ সুবিধা রাখবেন জানি না। তবে সব সময়ের জন্য এটা চালু থাকলে আমাদের জন্য খুব উপকার হবে।"
ঊর্মি গ্রুপ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ফখরুদ্দিন টেক্সটাইলস লিমিটেড নামে তাদের একটি কারখানায় এ ধরণের 'ফেয়ার প্রাইস শপ' আগে থেকেই চালু রয়েছে। তবে বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে শ্রমিক-কর্মীদের কিছুটা রেহাই দিতে তারা ৪টি কারখানা ও ঢাকায় হেড অফিসসহ ৫টি পয়েন্টে প্রায় ১৪ হাজার কর্মীর জন্য এ সুবিধা চালু করেছে।
ঊর্মি গ্রুপের পরিচালক শামারুখ ফখরুদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "বাজারমূল্যের চেয়ে ১০-২০% কম দামে আমরা শ্রমিকদের পণ্য সরবরাহ করছি। শ্রমিকরা তাদের বেতনের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য এখান থেকে নিতে পারছে বাকিতে। মাস শেষে তাদের বেতনের সঙ্গে তা সমন্বয় করা হবে।"
কারখানা উদ্যোক্তা ও পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিকদের বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের লক্ষ্যে ফেয়ার প্রাইস শপ চালু করে আসছে বেশ কয়েকটি কারখানা। নতুন করে ফেয়ার প্রাইস শপ চালু কিংবা এককালীন বিনামূল্যে পণ্য সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে কেউ কেউ।
টিম গ্রুপ এমনই একটি কোম্পানি। টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, "সাধারণত আমরা ঈদের ছুটির আগে সকল কর্মীদের বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী দিয়ে থাকি, তবে এবার আমরা রমজানে তাদের প্রত্যেককে এক ব্যাগ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়ার পরিকল্পনা করছি।"
তিনি বলেন, "আশা করছি আমরা এই সপ্তাহের মধ্যে বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করতে সক্ষম হব।"
এছাড়াও কারখানার কর্মীরা তাদের ফেয়ার প্রাইস শপ থেকে বাজারমূল্যের ৭% থেকে ২০% কম দামে অনেকগুলো পণ্য কেনার সুযোগ পাবেন বলে যোগ করেন তিনি।
আগামী মাস দুয়েকের মধ্যে স্নোটেক্স গ্রুপ নতুন করে ফেয়ার প্রাইস শপ চালু করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কারখানাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ। এই গ্রুপের চারটি কারখানায় শ্রমিক-কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার।
কেবল কারখানা মালিকরা নন, বর্ধিত পণ্যমূল্যের এ পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের স্বস্তি দিতে এগিয়ে আসছে বায়ার ও ব্র্যান্ডগুলোও। সম্প্রতি বেলজিয়ান ফ্যাশন ব্র্যান্ড স্ট্যানলি স্টেলা গাজীপুরের কালিয়াকৈর এ অবস্থিত ইন্টারস্টফ অ্যাপারেলস লিমিটেডের পাঁচ হাজার শ্রমিককে বিনামূল্যে এককালীন নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দিয়েছে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) অংশ হিসেবে। এর আগেও একই ব্র্যান্ড তিন দফা সুবিধা দিয়েছিলো শ্রমিকদের।
এছাড়া দীর্ঘদিন থেকেই ডিবিএল গ্রুপ, ফকির ফ্যাশন, মোহাম্মদী গ্রুপ, অনন্ত গ্রুপ, এপিলিয়ন গ্রুপ, কিউট ড্রেস, স্কয়ার গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, এসকিউ সেলসিয়াস এবং নর্দার্ন অ্যাপারেলসহ ৩০টি প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বাজারের চেয়ে কম মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করে আসছে। বর্তমান দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও তারা এই কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
পোশাক খাতের বাইরে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপও তাদের প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিককে নিজস্ব পণ্য (যার মধ্যে চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি নিত্যপণ্য রয়েছে) ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করে আসছে বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানা গেছে।
ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তারা বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ ৪০ ধরণের পণ্য সরবরাহ করছেন। তাদের পণ্যতালিকায় নতুন করে ইলেক্ট্রনিক্সসহ আরো কিছু পণ্য যুক্ত করতে যাচ্ছেন। তাদের শ্রমিকরা বর্তমানে বাজারমূল্যের তুলনায় ১৫ থেকে ২০% কম দামে পণ্য পাচ্ছেন।
প্রশ্ন জাগে, শ্রমিকদের অপেক্ষাকৃত কম দামে এসব পণ্য সরবরাহে কারখানাগুলোর উপর কি বাড়তি ব্যয়ের চাপ তৈরি হয়েছে নাকি। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত কারখানা মালিকরা জানিয়েছেন, এটি ব্যবস্থাপনার জন্য বাড়তি কিছু লোকবলের বাইরে তাদের তেমন কোন খরচ হচ্ছে না।
ঊর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, 'আমরা যে ভেন্ডরের কাছ থেকে এসব পণ্য নিচ্ছি, তাদের কাছ থেকে একটা ডিসকাউন্ট পাচ্ছি। ওই ডিসকাউন্ট প্রাইসেই আমরা শ্রমিকদের দিচ্ছি। এজন্য বাড়তি কোন ভর্তুকি দিতে হচ্ছে না।"
বাংলাদেশ অ্যাপারেল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি মোঃ তৌহিদুর রহমান বলেন, অন্যান্য কারখানা মালিকদেরও এমন উদ্যোগে এগিয়ে আসা উচিত। তবে এককভাবে করার চেয়ে অঞ্চলভিত্তিক কারখানা মালিকরা উদ্যোগ নিয়ে ওই অঞ্চলের কারখানার শ্রমিকদের জন্য এটি বাস্তবায়ন করলে ভালো ফল দেবে বলে মনে করেন তিনি।
অবশ্য নতুন করে কোন কোন কারখানা শ্রমিকদের এ ধরণের সুবিধা দিচ্ছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য বিজিএমইএ'র কাছে নেই বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম। তবে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জানান, অনেক কারখানাই তাদের মতো করে শ্রমিকদের কিছু সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে, যা তারা সেভাবে প্রকাশ করে না। অনেকে হয়ত শ্রমিকদের ইফতার বা অন্য কোন উপায়ে সহযোগিতা করছে।
তিনি অন্যান্য কারখানা মালিকদেরও ঊর্মি গ্রুপ কিংবা অন্য ফেয়ার প্রাইস শপ চালু করা কারখানার মতো সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
কারখানা মালিকদের এমন উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, কারখানা মালিকদের এই উদ্যোগের ফলে শ্রমিকরা বাজারমূল্যের তুলনায় কম দামে পণ্য পাচ্ছে এবং তাদের সময়ও বাঁচে। আরো বেশি প্রতিষ্ঠানের এ ধরণের উদ্যোগ নেওয়া এবং এজন্য কারখানা মালিকদের ভর্তুকি দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এছাড়া কেবল আরএমজি খাত নয়, অন্যান্য খাতের শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্যও আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য রেশন কার্ড ব্যবস্থা চালু করার উপর গুরুত্ব দেন তিনি।
তবে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও শ্রমিক নেতা নাজমা আক্তার মনে করছেন, বর্তমান বাজারে এসব উদ্যোগ শ্রমিকদের জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, "প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। শ্রমিকদের জন্য এই বেতনে চলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের রেহাই দিতে হলে নতুন করে মজুরি বোর্ড গঠন করে মজুরি বাড়ানো যৌক্তিক। অথবা মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়া এবং একই সাথে রেশন কার্ড চালু করা দরকার।"
রেশন কার্ড চালু করে শ্রমিকদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে পোশাক শিল্প মালিকরাও।
এই বছরের ১৫ মার্চ বিজিএমইএ, ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশকে (টিসিবি)-কে অনুরোধ করেছিল যে, গার্মেন্টসপ্রবণ এলাকাতে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবিক্রির জন্য তারা যেন ৪০টি ট্রাকের ব্যবস্থা করে দেয়।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান টিসিবি চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দেন।
তবে বিজিএমইএ সূত্র জানিয়েছে, এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি হয়নি। ফারুক হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, টিসিবির ট্রাক যখন পণ্য বিক্রি করে, তখন শ্রমিকরা কারখানায় থাকে। এজন্য শ্রমিকদের স্বার্থে বিক্রির সময় বাড়িয়ে দেওয়া দরকার।
গত দুই বছরে কোন কোন নিত্যপণ্যের দাম ৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে মোটা ডালের দাম ৪১%, ভোজ্য তেল ১৭%, চিনি ১৩% ও আটার দাম বেড়েছে ১৭%%।
আমদানি নির্ভর কিছু পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে দামবৃদ্ধিকে এর জন্য দুষছেন ব্যবসায়ীরা। তবে অনেকেই এজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দুর্বলতা ও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন।
ম্যাপড ইন বাংলাদেশের (এমআইবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে রপ্তানিমুখী ৩,৮০৫টি কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা ২৮ লাখের কিছু বেশি। তবে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের দাবি, পোশাক খাতে শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ লাখের ওপরে।