মূল্যস্ফীতি লাগামহীন, তাহলে বেতন কেন বাড়ানো হবে না?
গত বছর যখন ভোক্তা পর্যায়ে পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়ছিল তখন প্রভাবশালী একটি ট্রেড ইউনিয়ন মূল্যস্ফীতির সাথে তাল মিলিয়ে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইসিবির প্রতি মজুরি বা বেতন বৃদ্ধির দাবি জানায়।
মূল্যস্ফীতির কারণে বাড়তি অর্থ আদায়ে তৃণমূল পর্যায়ের এ চেষ্টাটি শেষপর্যন্ত সফল হয়নি, কিন্তু এতে ইউরো অঞ্চলে মূল্য স্থিতিশীলতা রক্ষার ভার যে সংস্থাটির কাঁধে তাদের অসংবেদনশীল মনোভাব প্রকাশ পায়। কারণ, সার্বিক বিচারে বেতন-ভাতার সমন্বয়ই শেষমেষ নির্ধারণ করে মূল্যস্ফীতির আঘাত থেকে কোন শ্রেণির ভোক্তাকে রক্ষা করা হবে।
ইসিবির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়, ১৯৭০'এর দশকের তুলনায় ইউরোপে মূল্যস্ফীতি হারের সাথে বেতন বৃদ্ধির সংযোগটি সৌভাগ্যবশত এখন অনেক বেশি চর্চিত। বার্ষিক সাড়ে ৭ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় ইসিবি বর্তমানে ভোক্তামূল্যের সাথে সমন্বয় করে বাড়তি মজুরিকে সমর্থন দিয়ে মূল্যস্ফীতির চক্রকে আরও শক্তিশালী হতে দিতে চাইছে না। কারণ তাতে আখেরে পণ্য ও সেবার মূল্য আরও বাড়বে।
ক্রমবর্ধমান মূল্যের সাথে মজুরি সমন্বয় না করলে, মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় দফা বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনেকটাই কমে আসে– যদিও তার ফলে ভুক্তভোগী হয় ক্রয় সক্ষমতা কমে আসা কর্মীরা।
মূল্যস্ফীতি যত দীর্ঘদিন ধরে চলমান থাকে, ততোই নীতি-নির্ধারকদের ওপর বাড়তে থাকে জীবনযাপনের ব্যয়ের সাথে মজুরির সামঞ্জস্য আনার চাপ। এই বাস্তবতায় জনগণকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেতন বৃদ্ধির দাবি ভুলতে বলা হলে তা কখনোই ভালো প্রতিক্রিয়া জাগায় না। গত ফেব্রুয়ারিতে খুব জোর দিয়ে তেমন আহ্বান জানিয়ে সমালোচনার মুখেই পড়েন ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি।
কর্মীদের হাতেও আছে কিছু কার্যসিদ্ধি বা দাবি আদায়ের উপায়। বর্তমানে ইউরো জোনে বেকারত্ব রয়েছে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। আটলান্টিকের অপর পাড়ের আমেরিকাতেও (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) সংগঠিত শ্রমিক জোটগুলির আওয়াজ আরও জোরালো হচ্ছে। অন্যদিকে, ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি জার্মানির ইস্পাত শিল্পের কর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি ট্রেড ইউনিয়ন বেতন সাড়ে ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধির দাবি তুলেছে।
কর্মীদের নাখোশ হওয়ার পেছনেও আছে একাধিক কার্যকারণ। লেনদেনের প্রকৃত মূল্য নিশ্চিত করতে 'সমন্বয়' অর্থনীতির এক বহুল প্রচলিত উপায়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই সমন্বয়ের কথা উল্লেখ করে কাঁচামাল বা মজুরির বাড়তি খরচের বোঝা ভোক্তার কাঁধে চাপিয়ে দেয়। বিদ্যুৎ, গ্যাসের মতো ইউটিলিটি পরিষেবা, টেলিকম কোম্পানি ও বাণিজ্যিক আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ব্যয় চূড়ান্ত গ্রাহকের ওপর চাপিয়ে দিতে বিশেষ সিদ্ধহস্ত। আর সেকারণেই বছর বছর কর্পোরেট মুনাফার পাহাড় ছোঁয় নতুনতর উচ্চতা।
রাষ্ট্রীয় পেনশনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির আঘাত তেমনভাবে পড়ে না। যেমন ইউরো জোনের সকল দেশে সরকারিভাবে দেওয়া অবসর ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদির অঙ্ক সমন্বয় করা হয়। আমেরিকার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টণীও তার বাইরে নয়। ২০২২ সালের রেকর্ড মূল্যস্ফীতির সময়ে মার্কিন খাতটির সমন্বয় ৫.৯ শতাংশ বা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে।
সরকারি অবসরভাতা ভোগীরা মূল্যস্ফীতির যাঁতাকালে একেবারেই পড়েন না- সেকথা বলা হবে বাতুলতা। আসলে পণ্যের দাম বৃদ্ধির পরই সরকার সমন্বয় করে ভাতাও বাড়ায়। কিন্তু, দাম বৃদ্ধি ও তার প্রেক্ষিতে সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নিতে যতদিন দেরী হয়- সেই ফাঁকে ক্রয়ক্ষমতা কমে রয় পেনশনারদের।
ঠিক একারণেই জানুয়ারি থেকে না করে গ্রীষ্ম থেকে পেনশন ভোগীদের ভাতার পরিমাণ সমন্বয় করে বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। সে তুলনায় গত শরৎকালের মূল্যস্ফীতি হার অনুসারে চলতি মাসে যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয় পেনশন ৩.১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। অথচ এটি মূল্যস্ফীতির বর্তমান হারের প্রায় অর্ধেক।
করনীতিতেও আছে সমন্বয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বেতনভাতা সামান্য বাড়িয়ে কর্মীদের বঞ্চিত করা রোধেই সাধারণত এ ব্যবস্থা প্রয়োগ করে সরকার। গত বছর যুক্তরাজ্যে বরিস জনসন সরকার মৌলিক কিছু আয়কর আদায়ের সীমাকে নতুন করে মূল্যস্ফীতির সাথে সমন্বয়কে ২০২৬ সাল পর্যন্ত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলস্বরূপ; এখন বেতন সামান্য বাড়লেই যুক্তরাজ্যের অনেক কর্মীকে আরও বেশি কর দিতে হবে। জীবনযাপনের খরচ মেটাতে এতে মানুষের টানাটানি বাড়বে নিঃসন্দেহে। করসীমা সমন্বয় করে না কমানোয়, এরমধ্যেই দুই হাজার কোটি পাউন্ড অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করেছে ব্রিটিশ সরকার, যা ছিল প্রক্ষপণের চেয়েও অনেকটা বেশি।
সরাসরি বাজেটে কাটছাঁট করার চেয়ে সমন্বয়ে গজামিল দেওয়াই হয়তো অনেক বেশি কৌশলী উপায়। তাতে শোরগোলও কমই হয়। সেদিক থেকে বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও তাদের জন্য নির্ধারিত বর্তমান সীমা বা ৯ হাজার ২৫০ পাউন্ডের বেশি টিউশিন ফি আদায় না করতে বলেছে সরকার। একারণে আগামী দুই বছরে তাদের তহবিল আরও কমবে। ছাত্ররা কী তবে প্রচুর সুবিধা পেল?- না তেমন ভাবনা আসলে অবান্তর। কারণ টিউশন ফির অর্থ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয় শিক্ষার্থীরা। আর বর্তমানে মূল্যস্ফীতির কারণে সেই ঋণের সুদ এখন ১২ শতাংশের ঘরে পৌঁছেছে।
মূল্যস্ফীতির কারণে ব্রিটিশ সরকারকে বিপুল ঋণও নিতে হয়েছে, এসবের সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ ব্যয়ের বিলও নেহাত কম নয়। মূল্যস্ফীতির সাথে সমন্বয় করা সুদহারের কারণে যুক্তরাজ্য সরকারের ওপর অতিরিক্ত ৩৫ বিলিয়ন পাউন্ড পরিশোধের ভার চাপে গত মার্চ নাগাদ। ইউরোপের অন্যান্য দেশের সরকারও একই ধরনের উভয় সংকটের মধ্যে পড়েছে।
সে তুলনায় বেতন বা মজুরি খাতে সমন্বয় ততোটা হয় না। অর্থনীতিবিদ ও কর্মদাতারা হয়তো সঙ্গত কারণেই এর পক্ষে যুক্তি দেন। আমরা যদি সরকারি ও বেসরকারি খাতে বেতনভাতা বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির ঘূর্ণিচক্র তৈরির ঝুঁকির দিকটি ছাড়াও আরেকটু বিস্তৃত পরিসরে তাকাই, তাহলে দেখব কর্মীদের জীবনযাত্রার বাড়তি ব্যয়ের সাথে তাদের মজুরির সামঞ্জস্য আনা হলে কোম্পানিগুলোর অর্থনৈতিক আঘাত বা যেকোনো মন্দা মোকাবিলার আর্থিক সামর্থ্য হ্রাস পায়। কমে যায় তাদের উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা। তাছাড়া, সবার আয়ে সামঞ্জস্য আনা হলে তাতে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার অতি জরুরি সামাজিক দাবিটিও কম ওঠে।
ইউরো জোনের মাত্র চারটি দেশ- বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা ও সাইপ্রাসে মূল্যস্ফীতির সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মজুরি কাঠামো নির্ধারণের বাধ্যবাধকতা আছে বলে জানিয়েছে ইসিবি। এই দেশগুলো ইউরো জোনের মোট বেসরকারি খাতের কর্মীদের মাত্র ৩ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। একইসাথে, পুরো ইউরো জোনের সরকারি খাতের কর্মীদের বেতনভাতার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ মূল্যস্ফীতির চাপের সাথে সমন্বয় করা হচ্ছে।
তবে এই সমন্বয়ের সীমিত উদাহরণই এখন আরও জনপ্রিয়তা পেতে পারে, কারণ ট্রেড ইউনিয়নগুলো জীবনযাত্রার ব্যয়ের চাপ কমানোর তাগিদ দিচ্ছে। জার্মানির ইস্পাত কর্মীরাই কেবল দাবি তোলেনি, চাপের মুখ স্পেন সরবকারও মজুরি সমন্বয় নতুন আঙ্গিকে গ্রহণ করছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিত্যপণ্যের বিশ্ববাজার দর এখন ক্রমাগত আকাশমুখী। এতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আশাবাদ ও সম্ভাবনা দুইই মলীন হয়ে পড়ছে। এ বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে বেশি বেতন বৃদ্ধির দাবির চেয়ে চাকরির নিরাপত্তার দিকটিতেই সবার মনোযোগ দেওয়া উচিত। তবে একথা বলতেও বাধা নেই, মানুষের প্রকৃত আয় হ্রাস রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বিস্ফোরকের স্তূপই তৈরি করবে।
- লেখক: ক্রিস ব্রিয়ান্ট মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গে শিল্প প্রতিষ্ঠান বিষয়ক মতামত কলাম লেখেন। ইতঃপূর্বে তিনি যুক্ত ছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী অর্থনৈতিক গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে।