খুলনা অঞ্চলের সরকারি পাটকলে আগ্রহ বিদেশি প্রতিষ্ঠানের
মালিকানা সরকারি থেকে বেসরকারিকরণে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব ১৩টি পাটকল লিজ নিতে ১৮টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান পাটশিল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। এরমধ্যে যে ৪টি বিদেশি প্রতিষ্ঠানলিজ পেতে যে আবেদন করেছে, তাদের সবাই খুলনা অঞ্চলের পাটকলগুলো লিজ পেতে আগ্রহী।
দরপত্র অনুযায়ী, খুলনা অঞ্চলের সাতটি মিল ভাড়াভিত্তিক লিজ দেওয়া হবে। এই অঞ্চলের সবগুলো মিল লিজ পেতে আবেদন জানিয়েছে ভারতের প্যাসিফিক জুট লিমিটেড এবং মোহন জুট লিমিটেড।
এছাড়া, দুবাইয়ের এশিয়াটিক ট্রেডিং এলএলসি এবং অস্ট্রেলিয়ার গোল্ডেন ফাইবার পিটিআই লিমিটেড যথাক্রমে খুলনা অঞ্চলের তিনটি ও দুটি মিল লিজ পেতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
লোকাল প্রতিষ্ঠান খুলনা অঞ্চলের কয়েকটি মিল পেতে দরপত্র জমা দিয়েছে। তবে বিজেএমসির ইভালুয়েশন কমিটির বিচার-বিশ্লেষণ ও সরকারের অনুমোদনের পরই চূড়ান্ত হবে।
বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) তথ্য অনুযায়ী, দরপত্রে পাটকল লিজ পেতে ১৪টি লোকাল প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের কেউ কেউ আগে থেকে পাট খাতে ব্যবসা করছে আবার কেউ কেউ একদমই নতুন।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলের ১৩টি রাষ্ট্রায়াত্ত্ব জুটমিল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিবে সরকার।
দরপত্র অনুযায়ী, শুধু পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদনে ৫-২০ বছরের জন্য ভাড়াভিত্তিক লিজ নিতে পারবেন আগ্রহীরা।
বিজেএমসির কর্মকর্তারা জানান, বেসরকারিকরণে প্রথম দফার দরপত্রে খুলনার তিনটি পাটকলে কোনো আবেদন পড়েনি, তবে এবার সবগুলো মিলের বিপরীতে আবেদন পাওয়া গেছে।
কারণ জানতে চাইলে তারা মনে করেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার কারণে হয়তো এই অঞ্চলের বিদেশীদের আগ্রহ বেশি। খুলনায় সমুদ্র বন্দর রয়েছে, নদী ও সড়ক পথেও যোগাযোগ ভালো।
বিজেএমসির প্রধান মূখ্য কর্মকর্তা (চিফ অপারেটিং অফিসার) মোহাম্মদ জামাল হোসেন টিবিএসকে বলেন, "সরকারি মিলগুলো লিজ পেতে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের আগ্রহ ব্যাপক। মিলগুলোর অনেক জমি রয়েছে। সরকার লোকসান কমাতে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিচ্ছে মিলগুলো।"
তিনি বলেন, "প্রাথমিকভাবে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে আগ্রহ পাওয়ার পর চুড়ান্ত প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। আগামী ২৫ মে'র মধ্যে প্রস্তাব পেলে ইভাল্যুয়েশনের পর লিজের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।"
"কয়েক মাসের মধ্যেই হয়তো প্রক্রিয়াটি শেষ হবে, যেন দ্রুত মিলগুলো উৎপাদনে ফিরতে পারে। কারণ মিলগুলো চালু হওয়ার সঙ্গে কর্মসংস্থানের বিষয় জড়িত।"
চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ১৩টি রাষ্ট্রায়াত্ত্ব পাটকল লিজ দিতে দ্বিতীয় দফায় আর্ন্তজাতিক দরপত্র আহ্বান করে বিজেএমসি।
এর আগে গতবছর ১৭টি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে টেন্ডার আহ্বান করে বিজেএমসি। ওইদফায় দেশীয় কয়েকটি বড় গ্রুপ পাট খাতে বিনিয়োগের জন্য ব্যাপক আগ্রহ দেখায়।
তবে চূড়ান্ত বিনিয়োগ প্রস্তাবনা ও প্রাইস কোটেশন কম হওয়ায় বিজেএমসি মিলগুলো সস্তায় লিজ দেয়নি।
মাত্র চারটি মিল লিজের জন্য চুড়ান্ত করা হয়। যার মধ্যে বে গ্রুপের হাত ধরে নরসিংদীর পলাশে অবস্থিত বাংলাদেশ জুট মিলস ও চট্টগ্রামের ইউনিটেক্স গ্রুপের মাধ্যমে কেএফডি জুট মিলে উৎপাদন শুরু হয়েছে।
দুটি প্রতিষ্ঠান মিল লিজের চূড়ান্ত অনুমোদন পেলেও মিল বুঝে নিতে পারেনি।
এর আগে, ২০২০ সালের জুলাই মাসের রাষ্ট্রায়াত্ত্ব পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। মিলের ২৫ হাজার শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক প্রদান করা হয়।
শ্রমিকদের পাওনার প্রায় ৯৭ শতাংশ পরিশোধ করেছে সরকার, তবে শ্রমিকদের মামলা ও অন্যান্য জটিলতার কারণে অবশিষ্ট পাওনা পরিশোধ করতে পারেনি।
লিজ দিলে সরকারের কী লাভ?
পুরনো মেশিনারিজে আশানুরূপ উৎপাদন না হওয়া, লাগামহীন দূর্নীতি ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের কারণে ধুঁকছে পাটকলগুলো। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বড় অংকের লোকসান গুনছে সরকারি পাটকল।
যদিও সঠিক ব্যবস্থাপনার কারণে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এই সেক্টরে ভালো মুনাফা করছে।
যার জন্য পাটকলের লোকসান থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে সরকার। অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২১ এর তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিজেএমসির আওতায় পরিচালিত মিলগুলোতে সরকারে লোকসান হয়েছে ৩৮০ কোটি টাকা।
আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে লোকসান ছিল ৭৭৩ কোটি টাকা।
এখন সরকার পাটকলগুলো ভাড়াভিত্তিক লিজ দিবে। মিলগুলোর জমি ব্যবহারের মাধ্যম্যে লিজ পাওয়া বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদন করবে।
বিজেএমসির কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, সবগুলো মিল লিজ দেওয়া হলে প্রতি বছর সরকার বড় অংকের রাজস্ব পাবে।
কারণ মিলের জমি ও মিলের মেশিনারিজ ব্যবহারের বিনিময়ে উদ্যোক্তারা পাটকলগুলো ভাড়া দিবে। সেই ভাড়া থেকে কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব পাবে সরকার।
সরকারি মিলে যেসব শ্রমিক ছিল তাদেরও কর্মসংস্থান হবে। যদিও মিল লিজের চুক্তিতে মিলের পুরনো শ্রমিকরাই নিয়োগ পাবেন, এমনটা নিশ্চয়তা নেই।
তবে মিল চালাতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শ্রমিকদের প্রয়োজন হবে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। ফলে মিলের পুরনো শ্রমিকদের সবার কর্মসংস্থান নিশ্চিত না হলেও বড় অংশ কাজের সুযোগ পাবে বলে মনে করছেন বিজেএমসির কর্মকর্তারা।
পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি কমছে
বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়লেও বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি কমছে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট ও পাটজাত পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।
পাট শিল্পে রপ্তানি বাণিজ্যে বেসরকারি খাতের অংশীদার বেশি হলেও সরকারি পাটকলগুলোও উল্লেখ্যযোগ্য অংশ বিদেশি পণ্য রপ্তানি করতো।
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয়মাসে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ।
যদিও রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি কমেছে ১৭ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে পাট ও পাটজাত রপ্তানি হয়েছে ৮৮.৭০ কোটি ডলার, যা আগের বছর ছিল ৯৫.৩৫ কোটি ডলার।
এই সময়ে শুধুমাত্র কাঁচা পাট, মানুষের তৈরি ফিলামেন্ট ও প্রধান তন্তুর রপ্তানি বেড়েছে। পাটের সুতা, বস্তা ও ব্যাগ রপ্তানিতে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
সরকারি জুট মিলস এবং বিজেএমসি
স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে ৭৫টি পাটকল ছিল।
১৯৭২ এর ২৬ মার্চ প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের মালিকানাধীন বেসরকারি এবং পরিত্যক্ত ৭৮টি মিল তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে বিজেএমসি গঠিত হয়।
১৯৮১ সালে পাটকলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২। ১৯৮২ এর পর ৩৫টি মিল বেসরকারিকরণ করা হয়। সেসময় সরকার আটটি থেকে মূলধন প্রত্যাহার করে এবং একটি মিল ময়মনসিংহ জুট মিলের সাথে একীভূত করে।
এরপর ১৯৯৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ১১টি মিল বন্ধ, বিক্রি বা অন্যান্য মিলের সাথে যুক্ত করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে ২০০২ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া আদমজী জুট মিল।
বিজেএমসি এরপর ২০১১ সালে দুটি এবং ২০১৩ সালে তিনটি মিলের উৎপাদন পুনরায় শুরু করে। এই সময়ের মধ্যে চালু মিলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২।
এরমধ্যে পাঁচটি মিল সংক্রান্ত মামলা আদালতে চলছে, অন্যদিকে ভিসকোস [কাপড়, গৃহসজ্জার সামগ্রী এবং বিছানায় ব্যবহৃত একটি আধা-সিন্থেটিক উপাদান] উৎপাদনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
বিজেএমসির আওতাধীন সরকারি ২৫টি পাটকল ব্যাপক লোকসান ও অতিরিক্ত উৎপাদন খরচের কারণে গত বছরের ১ জুলাই বন্ধ করে দেয় সরকার।