দেশে উৎপাদিত রাইস ব্রান, সরিষা হতে পারে সয়াবিন-পামের আমদানি বিকল্প
এক দশক আগে গড়ে ওঠা রাইস ব্রান অয়েল ইন্ডাস্ট্রির সক্ষমতা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হওয়ায় ভোজ্যতেলে এখনো আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরতা ৯০ শতাংশের বেশি। অথচ রাইস ব্রান অয়েল ও সরিষার তেলের উৎপাদন বাড়াতে পারলে এই নির্ভরতা এক-দুই বছরের মধ্যেই অন্তত ৫০ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন ভোজ্যতেল উৎপাদনে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো।
সাত বছর আগে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন রাইস ব্রান অয়েল ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে একটি গবেষণা করে, যখন দেশে রাইস ব্রান ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ আসতে শুরু করে। সে গবেষণায় তুলে ধরা হয়, এক দশকে অন্তত ৮ লাখ টন রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদন সম্ভব।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, প্রতিবছর ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে ২০ লাখ টন। যেখানে দুই লাখ উৎপাদন হয় স্থানীয়ভাবে। বাকি ১৮ লাখ টন সয়াবিন ও পাম অয়েল আমদানি হয় ভোজ্যতেল হিসেবে।
এর মধ্যে আবার অর্ধেকের বেশি আসে পাম অয়েল। এই পাম অয়েলের ৮০ শতাংশই আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বন্ধের কারণে শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশই ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকটে পড়েছে। কারণ এর আগে সানফ্লাওয়ারের বড় রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তাদের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অয়েল সিড হিসেবে সরিষা, গ্রাউন্ডনাট, তিল, সয়াবিন ও সানফ্লাওয়ারের চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে তেলবীজের মোট উৎপাদন ছিল ৫,৮৮,৯৫৪ মে. টন, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩২ হাজার টন বেশি। এর সঙ্গে রয়েছে রাইস ব্রান অয়েলের উৎপাদন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সবমিলে স্থানীয়ভাবে ভোজ্যতেলের উৎপাদন ২ লাখ ৩ হাজার মে. টন।
এই পরিস্থিতিতে যখন চায়না, ভারতের মতো বড় দেশগুলো ভোজ্যতেলের বিকল্প খুঁজতে ব্যস্ত তখন বাংলাদেশেও আলোচনা চলছে সয়াবিন ও পাম অয়েলের বিকল্প নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিকল্প হিসেবে বাদামের তেল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঠিকঠাক পরিকল্পনা করতে পারলে- রাইস ব্রান অয়েল, সরিষা, সানফ্লাওয়ার তেলের উৎপাদন বাড়াতে পারলে তা দিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বড় ধরনের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা পাম অয়েলের বিকল্প সানফ্লাওয়ার অয়েল সহ অন্য যেসব তেল রয়েছে সেগুলোর আমদানি বাড়ানোর বিষয়ে কাজ করছি। একইসঙ্গে দেশে তেল উৎপাদনের যেসব উৎস রয়েছে, সেগুলো থেকেও উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে সরকারিভাবে আলোচনা ও পরিকল্পনার সুযোগ রয়েছে।'
এদিকে গবেষণার ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও সরকারি নীতি সহায়তা, কাঁচামালের সংকট, ভেজাল দেয়া, যথাযথ মার্কেটিং পলিসি ঠিক করতে না পারার কারণে রাইস ব্রান অয়েলের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়নি। যে কারণে রাইস ব্রান অয়েলের উৎপাদন এখনো এক লাখ টনের নিচে। ইন্ডাস্ট্রিও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কিছু প্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগ করেও উৎপাদন থেকে সরে গেছে।
পাশাপাশি বাংলাদেশে বেশ আদি ফসল হিসেবে পরিচিত সরিষার উৎপাদন খুব বেশি বাড়ানো যায় নি। চাহিদা থাকার পরও উৎপাদন স্বল্পতার কারণে দেশে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ৩৫০ টাকারও বেশি দামে একেক লিটার তেল বিক্রি করছে। সরিষার তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে চাহিদা পূরণ করতে পারলে এই দামও কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
রাইস ব্রানের সংকট যেখানে
ট্যারিফ কমিশনের গবেষণায় উঠে আসে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে আড়াই লাখ টন রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদন সক্ষমতার ১৫টি কারখানা স্থাপিত হয়। এই পরিমাণ তেল উৎপাদনের জন্য ১৩ লাখ টন রাইস ব্রান দরকার।
প্রতি বছর দেশের ভিতর থেকেই কুঁড়া উৎপাদন হয় ৩৬ লাখ ১৫ হাজার টনের বেশি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত স্বাভাবিক সরবরাহ পাওয়া গেলেও কুঁড়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ লাখ টন। কিন্তু সেখানে কোম্পানিগুলো সারাবছর মাত্র সাড়ে ৪ লাখ টন কুঁড়ার সরবরাহ পায়। সাড়ে ছয় কেজি চালের কুঁড়া থেকে এক কেজি রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদন হয়। আর ধান থেকে চাল তৈরি করলে ৭-৮ শতাংশ কুঁড়া পাওয়া যায়।
যে কারণে ধীরে ধীরে অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের উৎপাদন থেকে সরে গেছে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, রাইস ব্রান উৎপাদনের জন্য ২০টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নিয়েছে। এর মধ্যে যারা উৎপাদনে রয়েছে তারা প্রতিদিন প্রায় ২৫০ টনের মত রাইস ব্রান উৎপাদন করছে।
তবে সেক্টর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাড়ে চার লাখ টন কুঁড়া সংগ্রহ করাই কষ্টকর। কারণ দেশের নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গা ছাড়া অটো রাইস মিল নেই। ফলে এখনো অর্ধেকের বেশি ধান ভাঙানো হয় লোকালি। এখান থেকে তৈরি হওয়া কুঁড়া দিয়ে ভালো মানের রাইস ব্রান পাওয়া যায় না। রাইস ব্রানের জন্য ভালো মানের কুঁড়ার বিকল্প নেই, যেটা পাওয়া যায় অটো রাইস মিলের মাধ্যমেই। আবার চালের কুঁড়ার একটা বড় অংশ এখন পোল্ট্রি ফার্ম ও মাছের খাবার তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে।
উদ্যোক্তারা জানান, কাঁচামালের সংকটের পাশাপাশি কারখানা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসের যোগান নেই। উৎপাদন কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না থাকার কারণে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
রাইস ব্রানের উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলো বলছে, রাইস ব্রানে খুব ভালো বাজার রয়েছে। কিন্তু কাঁচামাল ও গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো সংকটে পড়ছে।
বাংলাদেশের প্রথম রাইস ব্রান অয়েল হলো এমারেল্ড অয়েল (স্পন্দন ব্র্যান্ড)। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল হোসেন টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশে রাইস ব্রান অয়েলের সম্ভাবনা খুবই ভালো। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে কাঁচামাল ও গ্যাসের সংকট দূর করা গেলে দ্রুতই এর উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
কারণ কাঁচামাল ও গ্যাসের সরবরাহ ঠিক করে উৎপাদন বন্ধ কারখানাগুলোকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া গেলে দ্রুত দেশেই ভোজ্যতেলের সরবরাহ ব্যাপকভাবে বাড়ানো যাবে। কারণ এখন অনেক রিফাইনারি প্রস্তুত থাকলেও সেখানে উৎপাদন করা যাচ্ছে না বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এই প্রতিষ্ঠানটিরও একই অবস্থা। রিফাইনারি ঠিকঠাক থাকলেও গ্যাসের সরবরাহের কারণে তেল উৎপাদন করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।
যমুনা এগ্রো প্রডাক্টস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার সুভাষ কুন্ডু দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চালের কুঁড়ার সমস্যাটাই সবচেয়ে বেশি। এর জন্য দেখা যায়, বছরের একটা সময় উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়।'
সরিষা, সানফ্লাওয়ার ও পেরিলা তেলের সম্ভাবনা
ভারতভিত্তিক কমোডিটি মার্কেট রিসার্চ প্রতিষ্ঠান- মোরডোর ইন্টেলিজেন্স বাংলাদেশে সরিষার তেলের বাজার নিয়ে আলাদা আলাদা গবেষণা প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। দুটি গবেষণাতেই বাংলাদেশে সরিষার তেলের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার কথা বলা হয়েছে।
২০২৭ সাল পর্যন্ত ৫.৬-৫.৮ শতাংশ হারে এ তেলের বাজার বৃদ্ধি পাবে বলে সেখানে অনুমান করা হয়েছে।
"লকডাউন-পরবর্তী সময়ে, মানুষের খাদ্য গ্রহণের ধরনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেছে। বাইরে খাওয়ার প্রবণতা কমেছে; বরং নতুন নতুন রেসিপি নিয়ে নিরীক্ষা করে মানুষ বাড়িতেই খাবার বানিয়েছে বেশি। ফলে বাসাবাড়িতে সরিষার তেলের মতো ভোজ্যতেলের চাহিদা বেড়েছে।"
এদিকে সরিষার তেলের বাজারে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা শুরু করেছে। বাজার বৃদ্ধির কারণে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথাও বলা হয়েছে। বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে তাদের মধ্যে প্রাণ, উইলমার ইন্টারন্যাশনাল, অভিজাত ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল, পারটেক্স স্টার গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, এসিআই, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, ওরিয়ন গ্রুপ এবং ফার্মরুটস উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ঢাকায় এখন বিভিন্ন ছোট ছোট দোকানগুলোও লেবেলবিহীন বোতলে ভরে সরিষার তেল বাজারজাত করছে।
সরিষার তেলের পাশাপাশি সানফ্লাওয়ারের উৎপাদন বৃদ্ধিতে পরিকল্পনা করা যেতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া পেরিলা অয়েল নামের আরও একটি অয়েল সিডের চাষ শুরু হয়েছে দেশে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি হওয়ায় ইতোমধ্যেই এর উৎপাদনকারীদের সঙ্গে বিদেশি ক্রেতারা যোগাযোগ শুরু করেছেন। এ বছর প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে পেরিলা চাষের সম্ভাবনা রয়েছে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এইচ এম তারিক হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'ব্যাপকভাবে পেরিলা চাষের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কারণ এর আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ভালো। দেশের উচ্চ আয়ের মানুষের মধ্যে অনেক ক্রেতা আছেন, যাদের চাহিদা পূরণ করা হয় আমদানি করে। এর উৎপাদন বাড়ানো গেলে একই সঙ্গে রপ্তানি ও স্থানীয় মার্কেটের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।'