বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির আঁচ পেতে শুরু করেছে পোশাক খাত
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতও এর আঁচ পেতে শুরু করেছে। শনিবার রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসানও বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় পোশাক খাতের চাহিদা কমে আসবে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, "আমরা ইতিমধ্যে ইনফ্লেশনের চাপ অনুভব করতে শুরু করেছি। কিছু বায়ার ক্রয়াদেশ পিছিয়ে দিতে শুরু করেছেন। কেননা এমন পরিস্থিতিতে মানুষ খাবার কেনার জন্য খরচ করবে, আর পোশাক কেনা কিছুটা কমিয়ে দেবে।"
"বিষয়টি আমাদের সদস্যদের জানিয়েছি, তারা যাতে বিষয়টি মাথায় রাখে।"
আগামী নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য 'মেড ইন বাংলাদেশ সামিট ২০২২' এর লোগে উন্মোচন ও ৩৭তম ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন কনভেনশন উপলক্ষ্যে বিস্তারিত তুলে ধরতে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, "রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে একদিকে যেমন জ্বালানি তেলসহ খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে ইউরোপসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কাও বাড়ছে। সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহভাবে বাড়ছে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের চাহিদা ও ক্রয়ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। বিষয়টি আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার।"
প্রসঙ্গত, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি গন্তব্যের দেশগুলোতে সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এসব অঞ্চলের দেশগুলোতে ইনফ্লেশন এক দশকে সবচেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে চার দশকে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি এখন।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরাও তাদের কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু পোশাকের দাম কিছুটা বাড়লেও এখনো ফেয়ার প্রাইস আসছে না।
সম্প্রতি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত সাসটেইনেবল অ্যাপারেল ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে ফারুক হাসান বলেন, গত পাঁচ বছরে পোশাকের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৩০%। সম্প্রতি দাম কিছুটা বাড়লেও তারা এখনো মূল্য নিয়ে ভুগছেন।
যুদ্ধ পরিস্থিতিসহ মূল্যস্ফীতির জন্য পোশাকের ক্রয়াদেশে কিছুটা ধীর পরিস্থিতির কথা জানিয়েছেন পোশাক খাতের অন্যান্য উদ্যোক্তারাও।
ফতুল্লা অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ফজলে শামীম এহসান টিবিএসকে বলেন, "আমার ইউরোপের দুইজন বায়ার অর্ডার দেওয়ার পর তা আপাতত হোল্ড করতে বলেছেন। আমরা গত মাসগুলোতে যে গতিতে আসছিলাম, সেখানে এখন কিছুটা গতি মন্থরতা দেখা যাচ্ছে।"
গত কয়েক মাসে পোশাক রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও এ খাতকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে উল্লেখ করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, কাঁচামাল সংকট, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি, কন্টেইনার ও জাহাজ ভাড়া অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয় ও সাপ্লাই চেইনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উদ্যোক্তারা শিল্প টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন।
অবশ্য ব্যবসা সহজ করা, স্থিতিশীল ট্যাক্স ও ট্যারিফ পলিসিসহ রপ্তানিবান্ধব নীতি নেওয়া হলে এবং বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাক খাতের অগ্রগতিকে সঠিকভাবে তুলে ধরা গেলে আগামী সাড়ে তিন বছরে তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বিদ্যমান হিস্যা সাত শতাংশ বেড়ে ১০ শতাংশ হবে বলে আশার কথা জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি।
তিনি বলেন, ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে আমাদের শেয়ার ৭.৫% অতিক্রম করবে বলে আশা করি এবং ২০২৫ সাল নাগাদ তা ১০% ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তবে গত চার দশকের মডেলে ভবিষ্যতে পোশাক খাতের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কঠিন হবে উল্লেখ করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, "আমাদের পণ্যের কাঁচামালের ডাইভারসিফিকেশন হয়নি বললেই চলে। আমাদের কটন বেজড পোশাক থেকে ম্যান মেড ফাইবারের পোশাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি ম্যান মেড ফাইবারে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার চিত্র তুলে ধরেন।" তিনি নন-কটন পোশাকের উপর সরকারের প্রণোদনা দাবি করেন।
নভেম্বরে ঢাকায় মেড ইন বাংলাদেশ সামিট ও ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন কনভেনশন
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আগামী নভেম্বরে ঢাকায় বসতে যাচ্ছে সপ্তাহব্যাপী পোশাক খাতের এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় আয়োজন মেড ইন বাংলাদেশ সামিট, যার আয়োজক বিজিএমইএ। একই সময়ে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত আয়োজন হতে যাচ্ছে ৩৭তম আইএএফ ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন কনভেনশন, যার আয়োজক ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেল ফেডারেশন।
এ সময় আরো বেশকিছু প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হবে, এবং বায়ার, ব্র্যান্ড, সাপ্লায়ার, ফ্যাশন আইকনদের মিলনমেলায় পরিণত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে পোশাকের প্রাইস ট্যাগে বাংলা বর্ণমালায় যে কোন তথ্য রাখার বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা ও বায়ারদের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানান বিজিএমইএ সভাপতি। তিনি বলেন, "আমরা আশা করছি সব পক্ষের সহযোগিতা থাকলে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে তা শুরু করা যাবে।"
অনুষ্ঠানে আইএএস-এর সাধারণ সম্পাদক ম্যাথিজস ক্রিয়েটি গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের পোশাক খাতের অগ্রগতির প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, "আমরা সকলে শিল্পের যে ধরনের পরিবর্তন চাই, তাতে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে পোশাক প্রস্তুতকারকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।"
"৩৭তম আইএএফ ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন কনভেনশনের আন্তর্জাতিক মঞ্চে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিজেকে এ খাতের বিদ্যমান প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধানের উৎস হিসাবে তুলে ধরবে", যোগ করেন তিনি।