আগামী বছরের জুলাই থেকে কার্যকর হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন
আগামী বছরের জুলাই থেকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করবে সরকার। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ১৮-৫০ বছর বয়সীদের জন্য সর্বজনীন ব্যবস্থা উন্মুক্ত করাসহ ওই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বিপুল সংখ্যক নাগরিকদের এই পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনার পরিকল্পনা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা কার্যকর করতে তারা একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছেন। তাতে আগামী মার্চ থেকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার পাইলটিং শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে।
ইতোমধ্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে একটি অথরিটি গঠনের আইনের খসড়া তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মতামত সংগ্রহ করেছে অর্থ বিভাগ। সোমবার অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
"চলতি মাসেই আইনের খসড়াটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। সেখানে অনুমোদন পেলে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনেই এটি বিল আকারে পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে," বলেন অর্থবিভাগের একজন কর্মকর্তা।
বিল পাসের পর দ্রুতগতিতে অথরিটি গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়ের। এর পরপরই জরুরিভাবে দক্ষ ও টেকনিক্যাল লোক নিয়োগ দেওয়া হবে, যারা সর্বজনীন পেনশনের বিভিন্ন ধরনের প্রোডাক্ট তৈরি করবেন।
এই সময়ের মধ্যেই সর্বজনীন পেনশন বিধিমালা প্রণয়ন করা হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ সম্পন্ন করে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে পেনশন প্রোডাক্ট তৈরি করা হবে।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দু'জন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই মুহূর্তে সরকার দু'টি বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে, যার একটি ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব মোকাবেলা করা, অন্যটি আগামী বছরের জুলাই থেকে পূর্ণোদ্যমে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা।
আগামী নির্বাচনের আগে পুরোদমে এই পেনশন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে দেশের ভোটারদের কাছে সরকারের জনকল্যাণকর বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তারা।
আপাতত সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া ১৮-৫০ বছর বয়সীরা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতাভূক্ত হতে পারবে। প্রত্যেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা পরিশোধ করে ৬০ বছর পর থেকে আজীবন প্রতিমাসে পেনশন পাবেন।
সোমবার অর্থসচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বেশকিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, যার সমাধান আইনে নেই। যেমন- একজন কর্মকর্তা অর্থসচিবের কাছে জানতে চান, ১৮ বছর বয়সে কোনো নাগরিক সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত হওয়ার পর ২৪ বছর বয়সে ওই নাগরিক সরকারি চাকরিতে যোগদান করে, তাহলে তার পেনশন ব্যবস্থা কেমন হবে?
তিনি কি বিদ্যমান সরকারি পেনশন ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত হবেন, নাকি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায়ই থাকবেন? আর তিনি সরকারি পেনশন ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত হলে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় যে ৬ বছর চাঁদা দিলেন, তার কী হবে?
"বিষয়টি এভাবে আমরা ভেবে দেখিনি। আশা করছি, সর্বজনীন পেনশন বিধিমালায় এসব বিষয় পরিস্কার করা হবে," সভায় জানান অর্থ সচিব।
খসড়া আইনে প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ব্যবস্থার আওতায় মাসিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দেওয়া যাবে এবং অগ্রিম ও কিস্তিতেও চাঁদা জমা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল বাংলাদেশি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
এই ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির পর চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিয়ে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে এবং চাঁদাদাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জিভূত মুনাফাসহ জমার বিপরীতে পেনশন দেওয়া হবে।
৬০ বছর বয়স থেকে পেনশনারগন আজীবন, অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। তবে পেনশনে থাকাকালীন অবস্থায় বয়স ৭৫ বছর হওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করলে পেনশনারের নমিনি বাকি সময়কালের (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) মাসিক পেনশন পাবেন।
এছাড়া, কেউ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা পরিশোধ করার আগেই মুত্যুবরণ করলে, জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
পেনশন তহবিলে জমা করা অর্থ কোনো পর্যায়েই এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে চাঁদাদাতা তার জমা করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে উত্তোলন করতে পারবে, যা ধার্যকৃত ফিসহ পরিশোধ করতে হবে। ফিসহ পরিশোধ করা পুরো অর্থ চাঁদাদাতার নিজ একাউন্টেই জমা হবে।
পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াত দেবে সরকার। মাসিক পেনশন হিসেবে পেনশনার যে টাকা পাবে, তাও আয়করমুক্ত থাকবে।
নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা দুঃস্থ চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে, পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে। এ বিষয়ে সরকার সময় সময় প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারবে।
প্রতিটি চাঁদাদাতার জন্য একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র পেনশন হিসাব থাকবে। চাকরিরত চাঁদাদাতারা চাকরি পরিবর্তন করলেও, নতুন কর্মস্থলের বিপরীতে আগের হিসাব স্থানান্তর হবে। নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদান নতুন হিসাব খোলার দরকার হবে না।
খসড়া আইনে অর্থমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্যের একটি গভর্নিং বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের রাখার কথা বলা হয়েছে।
গভর্নিং বোর্ড পেনশন তহবিলের অর্থ সরকারি সিকিউরিটি, কম ঝূঁকিপূর্ণ অন্যান্য সিকিউরিটিজ, লাভজনক অবকাঠামোখাতে বিনিয়োগের জন্য নির্ধারিত গাইডলাইন অনুমোদন এবং কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দেবে।
২০১৪ সালের এপ্রিলে, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে প্রাক-বাজেট বৈঠকে প্রথমবারের মতো বেসরকারি খাতে পেনশন ব্যবস্থা চালু করার কথা বলেন।
সে বছর জুনে তার বাজেট বক্তৃতায় তিনি এ বিষয়ে একটি ঘোষণা দেন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে পেনশন প্রকল্প চূড়ান্ত করতে বলেন।
তিনি পরবর্তী বছরগুলোতে তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং ২০১৮ সালে বেসরকারি ব্যাংক এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কর্মচারীদের জন্য পেনশন স্কিম চালু করার লক্ষ্যে একটি পাইলট প্রকল্প চালু করার ঘোষণা দেন।
২০২১ থেকে একটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর ঘোষণাও দেন তিনি।
কিন্তু প্রথম ঘোষণার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোন বিভাগ পেনশন কার্যক্রম পরিচালনা করবে তা নিয়ে বিরোধের কারণে দুই বছর কেটে যায়।
পরের দুই বছরে অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি দল ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ সফর করেন এবং কিভাবে প্রোগ্রামটি চালু করতে হয় সে সম্পর্কে ২০১৬ সালে একটি উপস্থাপনা দেন।
কিন্তু, দলের প্রধান সাবেক অতিরিক্ত সচিব এআরএম নাজমুস সাকিবকে ২০১৭ সালে আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের অফিসে বদলি করা হলে উদ্যোগটি বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৯ সালে অবসরকালীন ছুটিতে (পিআরএল) চলে যান তিনি।
২০২০ সালে নাজমুস সাকিবকে একটি আউটসোর্সিং ব্যবস্থায় নিয়োগ দিয়ে ধারণাপত্র প্রস্তুত করার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু, করোনা মহামারির কারণে তা আর সম্ভব হয়নি।
প্রায় ছয় কোটির বিশাল জনবলের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করা একটি দুঃসাধ্য কাজ বলে উল্লেখ করে কর্মকর্তারা তখন বলেছিলেন, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো নির্মাণ, বিদেশী পরামর্শদাতা নিয়োগসহ কাজ শুরু করতে অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে।